নারীর সামাজিক মর্যাদা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বর্তমান প্রেক্ষিতে নারীর সামাজিক মর্যাদা আলোচনা কর।
অথবা, নারীর সামাজিক মর্যাদা বিশ্লেষণ কর।
অথবা,নারীর সামাজিক মর্যাদার বর্ণনা দাও।
অথবা, নারীর সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, নারীর সামাজিক মর্যাদা কী আলোচনা কর ।
উত্তরা৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশে নারীর সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান খুবই প্রান্তিক। অর্থাৎ সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান সর্বনিম্ন। এদেশে পরিবার প্রধান পুরুষ হওয়ায় পরিবারের মুখপাত্র হিসেবে তিনি সমাজে প্রতিনিধিত্ব করেন। এক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা পালনের কোন সুযোগ থাকে না। পরিবারের মধ্য থেকে নারীর পুরো জীবনটাই পুরুষের অঙ্গুলি নির্দেশ চলে। অর্থাৎ পুরুষের নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণে নারীর সারা জীবন পরিচালিত হয়। পুরুষের মতামতের উপরই তার জীবনের গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। এভাবেই পরিবারের মধ্যে পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার মধ্য দিয়ে নারীর সামাজিক মর্যাদা ও নারীর অবস্থান নির্ধারিত হয়।
নারীর সামাজিক মর্যাদা : সামাজিক ভাবে নারীরা বিভিন্ন দিক থেকে বা বিভিন্ন কারণে অধস্তনতার শিকার। নিম্নে নারীর সামাজিক মর্যাদা তুলে ধরা হলো :
১. পারিবারিক পদক্রনিক কাঠামো ও পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ : পারিবারিক পদক্রমিক কাঠামো ও পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ নারীর অধস্তনতার অন্যতম প্রধান কারণ। কেননা পারিবারিক কাঠামোর মাধ্যমে তৈরি হয়েছে পুরুষের মর্যাদাবোধ এবং পারিবারিক পদক্রম। এতে পুরুষ সব সময়ই পদক্রমের শীর্ষে অবস্থান করে। কেননা পরিবারের নেতৃত্ব দেয়ার মত সক্ষম ও বয়স্ক পুরুষের অনুপস্থিতিতেই কেবল নারী পরিবার প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করে। কিন্তু এরূপ মহিলা প্রধান পরিবারে পরিবার প্রধানের ভূমিকা ন্যূনতম হয় এবং সামাজিক জীবনেও এদের ভূমিকা নগণ্য। যা হোক, মতাদর্শ নারীর সামাজিক ভূমিকাকে সর্বনিম্ন করে। ফলে নারীর অবস্থান হয় অধঃস্তন।
২. ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি : আমাদের দেশে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়। নারীকে কখনোই স্বাধীন সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সমাজে নারী তার শৈশবকাল থেকেই কতকগুলো বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে, যা তাকে ‘নারীত্বের বোধ’-এ আবদ্ধ করে। যেমন-
ক. নারী হচ্ছে ঘরের শোভা।
খ.নারীদের হওয়া উচিত নরম, কোমল, কমনীয়, সহনশীল, স্বামী ও পরিবারের ইচ্ছার কাছে সমর্পিত ও নিবেদিত। নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল ও পুরুষের চেয়ে মেধা, মনন ও কর্মদক্ষতায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন।
ঘ.যতই শিক্ষিত হোক বা চাকরি করুক না কেন নারীদের আসল কাজ গৃহ। স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশ্ত বা স্বর্গ এ ধারণাগুলোর বিকাশ ঘটে নানাভাবে, নানা ক্ষেত্রে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, ভালোবাসা বা বিরূপ অনুভূতি প্রকাশে শিল্প-সাহিত্যে, সংবাদ প্রকাশে, গণমাধ্যম, সংগীত ও কৌতুক ইত্যাদিতে।
৩. পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা : পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা নারীকে সামাজিক দিক থেকে অধস্তনতায় নিপতিত করে। শৈশব কাল থেকেই অনাকাঙ্ক্ষা ও অবহেলার মধ্য দিয়ে একটি কন্যা শিশুর জীবনযাত্রা শুরু হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের ভূমিকাই যেহেতু মুখ্য, তাই এখানে পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষাটাই তীব্র। পুত্র সন্তানকে এখানে ভবিষ্যতের অবলম্বন হিসেবে দেখা হয়। আর এ কারণে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে ‘আযান’ দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। কিন্তু কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে আযান দিয়ে স্বাগত জানানো হয় না। বরং জন্মক্ষণ থেকেই তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। আর পুত্র সন্তান জন্ম না দিতে পারার অপরাধে নারীর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় ।
৪. লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন : লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন সামাজিকভাবে নারীর অধস্তনতার জন্য দায়ী। লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের কারণে নারীর কাজ গৃহের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং পুরুষের কর্মক্ষেত্র বাইরে। পরিবারের মধ্যে নারীকে কাজ করতে হয় বলে তার কাজের কোন আর্থিক মূল্য থাকে না। আর পুরুষেরা পাবলিক গণ্ডিতে কাজ করে বলে তাদের কাজ অর্থের সাথে সম্পর্কিত। ফলে নারীদের সামাজিক সম্পর্কের পরিধি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে এবং অন্যদিকে পুরুষের সামাজিক সম্পর্কের পরিধি বিস্তৃত হয়। লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন নারীর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে পুরুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
৫. শারীরিক পার্থক্য : শারীরিক পার্থক্যের কারণে নারীরা পুরুষের তুলনায় অধস্তন। বাংলাদেশের নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষের চেয়ে দুর্বল। আর পুরুষেরা প্রকৃতিগতভাবেই শারীরিক দিক দিয়ে নারীর তুলনায় শক্তিশালী। আর এটাই সামাজিকভাবে প্রচলিত রীতি। মূল্যনেতিবাচ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শৈশবকাল থেকেই নারীদের দুর্বল ভাবতে শিখানো হয়। ফলে কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না শারীরিক অদক্ষতার কারণে। ফলে নারীরা জীবনের শুরু থেকেই মানসিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর এ নির্ভরশীলতা থেকেই সমাজে নারীর অধস্তনতার জন্ম হয়।
৬. বৈবাহিক সম্পর্ক : বাংলাদেশে নারীর সামাজিক মর্যাদার নিম্নমানের কারণ হিসেবে বৈবাহিক সম্পর্ক ও মাতৃত্বকে দায়ী করা হয়। আমাদের সমাজে প্রচলিত বাস্তবতা যে সকল পরিবারেই বিবাহ নামক প্রথা নারীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিবাহের মাধ্যমেই একজন নারীর জীবনে পূর্ণতা আসে। কিন্তু এ বৈবাহিক সম্পর্কই নারীর জীবনকে আবার শৃঙ্খলিত
করে। বৈবাহিক জীবনে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন মূল্য থাকে না। পিতার সংসার থাকাকালীন সময়ে নারী হওয়ার কারণে যে মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়, স্বামীর সংসারে গিয়েও তাকে একই যন্ত্রণা পোহাতে হয়। তাই বলা যায়, নারীর পারিবারিক তথা সামাজিক জীবন খুবই দুঃসহনীয় ও করুণ ।
৭. মাতৃত্ব : সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থার জন্য মাতৃত্বকেও অনেকাংশে দায়ী করা হয়। মাতৃত্ব বা সন্তান জন্মদান একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এর সূত্র ধরেই সমাজে লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন তৈরি করা হয়। সন্তান জন্ম দেয়ার পর সন্তানের যত্ন বা পরিচর্যার পুরো দায়িত্ব মাকেই পালন করতে হয়। ফলে তার শিক্ষা জীবন, কর্ম জীবন, উভয়ই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কিন্তু পিতৃত্বের দরুন পুরুষকে কোন দায়িত্ব পালন করতে হয না। তাই বলা যায়, মাতৃত্বজনিত কারণে অত্যধিক দায়িত্বের বোঝা সমাজে নারীর উপর অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, এ সামগ্রিক আলোচনার যোগফল হচ্ছে সমাজে নারীর অবস্থান প্রান্তিক। আর এ প্রান্তিক অবস্থানের জন্য সমাজে নারীর কাজও অবহেলিত ও অবমূল্যায়িত। পুরুষতন্ত্রের শক্তিশালী কাঠামোতে নারীর মূল্যায়ন নারীকে অসম স্তরায়নের শিকার করেছে। তবে বর্তমানে নারীদের সামাজিক অবস্থান একটু একটু করে বদল হচ্ছে। নারীরা এখন তাদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান নির্ণয়ের জন্য পুরুষতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে শুর করেছে। নারীরা পারিবারিক পর্যায়ে পুরুষের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%85/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*