নারীবাদের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, নারীবাদের বিভিন্ন পর্যায় আলোচনা কর।
অথবা, নারীবাদের বিভিন্ন দিকের বর্ণনা দাও।
অথবা, নারীবাদ তত্ত্বের বিভিন্ন অবস্থান তুলে ধর।
অথবা, নারীবাদের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তুমি কী জান লিখ।
অথবা, নারীবাদের বিভিন্ন পর্যায়গুলো উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : নারীবাদ বর্তমান বিশ্বে একটি আলোচিত তত্ত্ব। বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে এ তত্ত্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ও জনসমর্থন আদায় করছে। তাছাড়া জ্ঞানের প্রতিটি শাখার তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকে। নারী শিক্ষার তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো নারীবাদ। নারীবাদ নারী আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি, তত্ত্ব ও শক্তি যোগায়। নারীবাদ সম্পর্কে নারীবাদী তাত্ত্বিকগণ যেসব তত্ত্ব দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে উদারপন্থি নারীবাদ, উগ্রপস্থি নারীবাদ, মার্কসীয় নারীবাদ, সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ উল্লেখযোগ্য। উদারপন্থি নারীবাদ সমাজসংস্কারের মাধ্যমে নারীমুক্তিতে বিশ্বাসী। র্যাডিক্যাল নারীবাদ সংস্কারে বিশ্বাসী নয়। উল্লেখ্য, উদারপন্থি নারীবাদী আন্দোলনের প্রচেষ্টা না থাকলে নারী আজকে যে পেশাগত ও বৃত্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে তা সম্ভব
হতো কি না সন্দেহ। মার্কসীয় ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা নারীনির্যাতন ব্যক্তির স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডের ফল না বলে
ব্যক্তির আর্থসামাজিক কাঠামোর ফলশ্রুতিকে বুঝিয়েছেন।
নারীবাদের বিভিন্ন দিক : নারীদের সাথে নারীবাদী মহিলা সংগঠন ও সদস্যরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী শিক্ষার পথিকৃৎ এসব নারীবাদী মহিলারা। নারী যে বহু পতন, অভ্যুদয়, বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তার পিছনে নারীবাদী মহিলাদের অবদান বেশি। নারীবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছে নারীবাদী মহিলারা, যার প্রমাণ মেলে নিম্নোক্ত আলোচনা হতে :
১. উদারপন্থি নারীবাদ : উদারপন্থিরা নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য ও সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে অসাম্য দূরীকরণের জন্য সমাজসংস্কারকগণ যথেষ্ট মনে করেন। নারীর বিদ্যমান অধস্তন অবস্থার জন্য দায়ী সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার ও সংশোধন করে বৈষম্য ও অসমতা দূর করা যাবে। যারা এ কাজ করেন, তারাই সংস্কারক। নারীমুক্তির জন্য উদারপন্থিদের সমাধানগুলো হলো :
ক. সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা : একদল উদারপন্থিদের বিশ্বাস সকল বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি বিলোপ করতে হবে।
নারীকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরুষের সাথে সমান তালে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দিলেই নারীরা সকল বৈষম্য হতে মুক্তি পাবে। এরপরও যদি বৈষম্য থেকে যায়, তবে করার আর কিছুই নেই। যেমন- একজন শিক্ষক যদি দু’জন সমমানের ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ছাত্রকে আনুকূল্য দেন, তবে তা দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
খ. বৈষম্যের জন্য ক্ষতিপূরণ : অনেক উদারপন্থি নারীবাদীগণ মনে করেন যে, নারীকে তার অতীত অবিচার ও বৈষম্যের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নারীমুক্তির পথে সকল আর্থসামাজিক ও আইনগত বাধা অপসারণ করতে হবে। তাহলে নারীমুক্তি সম্ভব হবে। এরা দাবি করেন যে, সকলক্ষেত্রে নারীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারীকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ সুবিধাদি দিতে হবে।
গ. বুদ্ধি ও মেধায় সমতা : নারী পুরুষে সমতা মিলের (Mill) রচনার একটি বিশেষ দিক। নারীদের মধ্যেও কতিপয় ব্যতিক্রমী মহিলা আছেন। এ সত্যকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে মিল জোর দিয়ে দাবি করেন যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে যে পার্থক্য দাবি করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে সকল নারীর একটি গড় অনুপাত ।
২. উগ্রপন্থি নারীবাদ : উগ্রপন্থিরা মনে করেন যে, নারীর অধস্তন অবস্থার জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর শিকড় বহুধা বিস্তৃত ও দৃঢ়মূল। তাদের সমূলে উৎপাটন না করলে নারীমুক্তি পাবে না। উগ্র বা র্যাডিকাল নারীবাদের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :
ক. কেন্ট মিলেটের মন্তব্য: কেন্ট তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে সাহিত্য, মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান থেকে দৃষ্টান্ত উত্থাপন করেছেন। কেন্ট দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেছেন যে, বিংশ শতাব্দীর জাগ্রত ও সংঘবদ্ধ নারীবাদ নারী নির্যাতনের চাবিকাঠি সেক্স বা জেন্ডার ব্যবস্থা ধ্বংস করবে। নতুন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, যেখানে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ হবে সমান ও সমর্যাদাসম্পন্ন।
খ. শুলামিথ ফায়ারস্টোনের অভিমত : শুলামিথ ১৯৭০ সালে তাঁর ‘The Dialectic of Sex’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। তিনি কেটের তুলনায় উগ্রপন্থি। কেটের সাথে অবশ্য তিনি একমত যে, প্রজননে নারী পুরুষের ভূমিকার মধ্যে নারীর অধীনতা ও পুরুষের প্রাধান্যের আদর্শিক ভিত্তি নিহিত। কিন্তু তিনি কেটের প্রদত্ত সমাধান যথেষ্ট মনে করেন না। তাঁর
মতে, বড় রকমের জৈবিক ও সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন।
৩. মার্কসীয় নারীবাদ : মার্কস ধনিকতন্ত্রকে শোষণ ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করেন। এ ব্যবস্থায় শ্রমিকের শ্রম দ্বারা উৎপাদন করা হয়। কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের মূল্য শ্রমিকের মজুরির সমান না হয়ে বেশি দাম নির্ধারিত হয়। মালিক উৎপাদিত পণ্যের মূল্যনির্ধারণ করে এবং শ্রমিকের মজুরির অতিরিক্ত যে মূল্যে সে পণ্য বিক্রয় করে পায়, তা মালিকের লাভ। মালিকের লাভ বস্তুত শ্রমের মূল্যের শোষণ, শ্রমিকের শোষণ । মার্কসীয় নারীবাদী প্রবক্তারা মার্কসের বিশ্লেষণ নারীর দেহ ব্যবসা ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করেন। মার্কসীয় নারীবাদ নিম্নোক্ত মূলনীতিতে বিশ্বাসী :
ক. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবারের তথাকথিত আর্থিক ভিত্তি ধ্বংস করে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসার ভিত্তিতে পরিবারের পুনর্গঠন করতে হবে।
খ. নারীকে জন শিল্পে, বহিরাঙ্গনে, কলকারখানা, অফিস আদালতে কর্মগ্রহণ করে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন
করতে হবে।
গ. গৃহকর্ম ও সন্তান পালন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামাজিকভাবে সংগঠিত করতে হবে। সমাজ গৃহকর্ম ও সম্ভ নি পালন অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সেবা শিল্পে পরিণত করবে।
ঘ. নারীর অর্থনৈতিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীর মুক্তির পূর্বশর্ত।
৪. সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ : সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ স্বীকার করে যে, ধনিকতন্ত্রের পতন না হলে নারীর মুক্তি নেই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী প্রবক্তারা দাবি করেন যে, পিতৃতন্ত্র উৎখাত না করলে ধনিকতন্ত্র ধ্বংস হতে পারে না। যতক্ষণ ধনিকতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তি, ততক্ষণ নারীমুক্তি সুদূর পরাহত। পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্র যতই না কল্যাণকামী রাষ্ট্রের দোহাই দিক, নারীর অধীনতা ও পরাধীনতা থেকে মুক্তি নেই। কেবল নির্যাতনের উভয় হাতিয়ার ধনিকতন্ত্র ও
পিতৃতন্ত্র উৎখাত হলেই নারীর প্রকৃত মুক্তি আসবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম বাঙালি মুসলমান নারীবাদী মহিয়সী বেগম রোকেয়া। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতা তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাঁর নামে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সড়কের নামকরণ হয়েছে। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন শ্রদ্ধাভরে পালিত হয়।মতিনি প্রথম মুসলিম নারী, যিনি নারী ও পুরুষের সমতা ঘোষণা করেন, “সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ, সমান সুযোগ পেলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারতাম না।” তবে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা ধ্বংস না করে নারীমুক্তি সম্ভব নয়। বুর্জোয়া
ব্যবস্থা থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের মধ্যে নারীমুক্তি নিহিত। উল্লিখিত থিওরিগুলো ছাড়াও কয়েকটি ছোটখাটো তত্ত্ব আছে,
যেমন— অস্তিত্ববাদী নারীবাদ, আধুনিক উত্তর নারীবাদ, পরিবেশ নারীবাদ, আন্তর্জাতিক নারীবাদ ইত্যাদি।