নয়নচারা’ গল্পের আমু শহরে এসে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল তা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আমু শহরে এসে শহর সম্পর্কে তার যে ধারণা জন্মেছিল তার ভাষাচিত্র অঙ্কন কর।
অথবা, ‘নয়নচারা’ গল্প অবলম্বনে আমুর দেখা শহর ও শহুরে মানুষের বর্ণনা দাও।
অথবা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিরচিত ‘নয়নচারা’ গল্পে গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যকার যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়েছে তা আলোচনা কর।
অথবা, ‘নয়নচারা’ গল্পে নগরজীবনের যে স্বার্থান্ধ বিকৃত রূপ নয়নচারা গ্রামনিবাসী আমুর চোখে ধরা পড়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : জীবনমুখী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জীবনকে দেখেছেন নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাঁর রচিত গল্প- উপন্যাসে এ বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর লেখনীতে মানুষের জীবনযন্ত্রণার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘নয়নচারা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিরচিত একটি জীবনমুখী ছোটগল্প । এ গল্পে কাহিনি বলতে তেমন কিছু নেই। দুর্ভিক্ষতাড়িত একদল মানুষ শহরে এসে যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে গল্পকার তারই শিল্পিত রূপটি তুলে ধরেছেন আলোচ্য গল্পে। ‘নয়নচারা’ সম্পর্কে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন- ‘মধুর মতো ছোট্ট একটি গল্প ‘নয়নচারা’। নয়নচারা থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত বহুলোক এসেছে শহরে দুটি ভাতের সে ছিন্নমূল মানুষদের একজন আমু। নস্টালজির, স্মৃতিচারণ এবং তাদের নির্মম পাঁচালিই ‘নয়নচারা’। গল্পের প্রধান লোভে চরিত্র আমু শহরে এসে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে নিচে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
আমুর দেখা শহর : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিরচিত ‘নয়নচারা’ গল্পের আমু দুর্ভিক্ষতাড়িত এক মানুষ । ময়ূরাক্ষী নদী তীরবর্তী নয়নচারা গ্রামে বাস করতো সে। দুর্ভিক্ষপীড়িত আমু গ্রামের অন্যান্যদের সাথে শহরে চলে এসেছে। এখানে সে আশ্রয় নিয়েছে প্রশস্ত রাস্তার পাশের ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে। সারাদিন আমু শহরের রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, মানুষের দরজায় দরজায় একমুঠো খাবারের জন্য ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কেউ তাকে ভালো চোখে দেখে না। শহর সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। এখানকার মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কে আমু ছিল অজ্ঞ। কয়েকদিনের মধ্যেই শহর সম্পর্কে তার মনে যে ধারণার সৃষ্টি হলো তা হলো- এখানকার রাস্তা, অলি-গলি, দোকান-হোটেল, ঘরবাড়ি এবং আবহাওয়া হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর। শহরের আকাশের নিচে “খাদ্য নেই, দয়ামায়া নেই, রয়েছে শুধু হিংসা-বিদ্বেষ-নিষ্ঠুরতা এবং অসহ্য বৈরিতা।” আমুর দেখা শহরের সাথে সে নয়নচারা গ্রামের কোন মিল খুঁজে পেল না।
আমুর দেখা শহরের মানুষ : আমু গ্রামের মানুষ। আগে সে কোনদিন শহরে আসে নি। শহরের মানুষগুলো যে এতখানি হৃদয়হীন তা সে আগে জানত না। এখানে এসে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য আমু মানুষের কাছে যে অবহেলা ও অবজ্ঞা পেয়েছে এটা ছিল তার ধারণার বাইরে। এখানকার মানুষের চোখে আমু কুকুরের হিংস্রতা দেখেছে। যারা তাকে দেখে দূর দূর করে তেড়ে এসেছে, তাদেরকে সে অন্ধ মনে করেছে। অথচ মানুষগুলো অন্ধ নয়। শহরে থেকে থেকে ওদের অন্তরের সুকুমার বৃত্তিসমূহ নষ্ট হয়ে -ব্যবহারে আমু মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছে। ধৈর্যহারা আমু গেছে। তাই তারা আমুদের অবজ্ঞার চোখে দেখে। শহরের মানুষগুলোর আচা একবার একজনের ব্যবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
শহরের আবহাওয়া : আমু ময়ূরাক্ষী নদীর তীরের নয়নচারা গ্রামের উন্মুক্ত আলো বাতাসের মধ্যে বড় হয়েছে। শহরের আবহাওয়া সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। এখানকার বাতাসে আর্দ্রতার অভাব। এ বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার। দম বন্ধ হয়ে আসা আবহাওয়া তার কাছে একেবারেই অপরিচিত। উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আমু ময়ূরাক্ষীর প্রাণজুড়ানো শীতল হাওয়ার জন্য আপসোস করে। শহরের কাঠফাটা রোদ আমুর অসহ্য লেগেছে। এখানে গাছ নেই, ছায়া নেই, ঘাস নেই। এটা কী রকম কথা। ক্লান্তিতে দেহ ভেঙে আসে অথচ ছায়া নেই। আলো তার কাছে বিরক্তিকর। সে একথা বলবে এমন লোক নেই। এখানকার এ ইটের দেশেতো নেই-ই, তার গ্রাম থেকে যারা এসেছে তারাও মন হারিয়েছে। শুধু গোঙানো পেট তাদের হা করে আছে অন্ধকারে চেয়ে । আমু এখানে নিঃসঙ্গ, একেবারেই নিঃসঙ্গ। এ নিঃসঙ্গতা কালের মতো আদিহীন, অন্তহীন।
শহরের মানুষের ব্যবহার : শহরের মানুষের মধ্যে কোমলতা নেই। এরা মানুষকে ভালোবাসতে জানে না। এক ময়রার দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমু ভিতরের সাজানো খাবার চেয়ে চেয়ে দেখছিল। ভিতর থেকে একটা লোক তাকে দেখে অন্ধের মতো তেড়ে এসেছিল। আর একবার এক খাবার হোটেলের সামনে দাঁড়ানোর অপরাধে দোকানদার তাকে মারতে ছুটে আসে। আমুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে ক্ষিপ্রবেগে লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলত বেদম মার খেয়ে তাকে আবার রাস্তায় ফিরে আসতে
হয়। এভাবে শহরের প্রত্যেকটা মানুষকেই তার নিষ্ঠুর নির্দয় বলে মনে হয়েছে।
কুকুর ও মানুষ : আমু দেখেছে শহরের কুকুরের চোখে বৈরিতা নেই কিন্তু মানুষের চোখে বৈরিতা আছে। এ ধরনের বৈরিতা সে দেখেছে তাদের গ্রামের কুকুরের চোখে। শহুরে মানুষদের আচার-আচরণ দেখে তাদেরকে আমু কুকুর ভেবে ভুল করে। একসময় সে জানতে পারে ওরা মানুষ, কুকুর নয় অথবা, ভেতরে কুকুর-বাইরে কুকুর নয়। এভাবে মানুষ আর কুকুরের পার্থক্যবোধ হারিয়ে ফেলে আমু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। শহরের মানুষের ব্যবহারের সাথে কুকুরের ব্যবহারের কোন পার্থক্য সে খুঁজে পায় না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ময়ূরাক্ষী নদী তীরের নয়নচারা গ্রামের মানুষ আমু বাঁচার আশায় শহরে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছিল তা ছিল তার কাছে একান্তই অকল্পনীয়। শহর, শহরের মানুষ, শহরের আবহাওয়া কোনকিছুর মধ্যেই সে প্রাণের সন্ধান পায়নি। সবকিছুকেই তার মনে হয়েছে প্রাণহীন, নির্দয় ও নিষ্ঠুর বলে ।