নব্য সুফিবাদ বলতে কী বুঝ? বাঙালির জীবনদর্শনে সুফিবাদের প্রভাব নিরূপণ কর।
অথবা, নব্য সুফিবাদ কী? বাঙালির জীবনধারায় সুফিবাদের প্রভাব কিরূপ ছিল?
অথবা, নব্য সুফিবাদ কাকে বলে? বাংলার জনজীবনে নব্য সুফিবাদের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, নব্য সুফিবাদ কাকে বলে? বাংলাদেশে নব্য সুফিবাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : বাংলাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক সাধনার চারণভূমি।সহজসরল, খোদাভীরু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বাঙালির চারণভূমিতে আধ্যাত্মিকতার বপিত বীজ সোনার ফসল ফলিয়েছে সে প্রাচীন কাল থেকেই। প্রাচীন কালে বাঙালির মননে আধ্যাত্মিকতার যে স্ফুরণ ঘটে তাই কালক্রমে এদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেয়। মধ্যযুগের বাঙালি চিন্তা, মনন ও জীবনাদর্শে বিকশিত তেমনি একটি মরমি আদর্শ হচ্ছে সুফিবাদ। যদিও সুফিবাদ বাঙালির নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত স্বকীয় আদর্শ থেকে উৎসারিত জীবনাদর্শ নয় বরং বহিরাগত উৎস থেকে উৎসারিত,তথাপি তা বাঙালির নিজস্ব জীবনদর্শনের সাথে মিশে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নব্যরূপ লাভ করে। এ নব্য প্রতিষ্ঠিত আধ্যাত্মিক দৃষিবাদী জীবনাদর্শ বাঙালির জীবন, মনন, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে তথা সার্বিকভাবে বাঙালির জীবনধারায় ব্যাপক ও সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
নব্য সুফিবাদ : সাধারণভাবে সুফিবাদ বলতে আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ণতা লাভের উপায়কেই নির্দেশ করা হয়। আর বাংলা হচ্ছে আধ্যাত্মিক ধ্যান অনুধ্যানমূলক চিন্তা তথা মরমিবাদের চারণভূমি। সহজসরল বাঙালির মনন বৈশিষ্ট আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা খুব সহজেই একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয়। অতি প্রাচীন কালে বিভিন্ন আতপ্রাকৃতিক সত্তা এবং প্রাচীন ধর্মসমূহকে আশ্রয় করে বাংলায় আধ্যাত্মবাদের সূচনা হলেও মধ্যযুগীয় বাংলায় বিশেষ করে তেরো শতকে। বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে ইসলামি মরমিবাদী চিন্তা বাঙালির মানসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। বলা হয় ইসলামি মরমিবাদ সুফি দর্শনের মাধ্যমেই বাংলায় অনুপ্রবেশ করে এ সময়ে পারস্য,বোখারা, সমর উত্তর ভারতের সুফিরা বাংলায় আসেন এবং এদেশীয়দের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। এদের প্রভাবে অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম, সংস্কার, আচার আচরণ, সাধনা ইত্যাদি একেবারে বর্জন করছে পারেননি। শুরু হয় গ্রহণ বর্জনের পালা। ফলশ্রুতি বাঙালির চিন্তা চেতনায় যেমন সুফিবাদের প্রভাব পড়ে তেমনি সুফিবাদও বাঙালির চিন্তা চেতনার দ্বারা পরিপুষ্টি লাভ করে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এগারো শতক থেকে ধর পনেরো শতক পর্যন্ত বাংলার সুফিবাদ তার মূল আদর্শ অক্ষুণ্ন রাখতে পারলেও ষোল শতক হতে এদেশীয় পারস্পরিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে চিশতিয়া, কলন্দরিয়া, মাদারিয়া, কাদারিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সুফি সাধক ও বাংলার বাঙালি সুফিদের দ্বারা এক নতুন ধর্ম ও দার্শনিক আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ, সুফিবাদের সাথে বাংলার দেশছ লোকজ ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, প্রথা, তন্ত্র, যোগ, দেহ সাধনার সংমিশ্রণে বিভিন্ন উৎস থেকে আগত সুফি চিন্তাধারা একটি নব্য রূপ লাভ করে। ড. এনামুল হক বাংলায় বিকশিত সুফিবাদের এ নতুন নব্য রূপটিরই নাম দেন নব্য সুফিবাদ।
বাঙালির জীবনদর্শন বা জীবনধারায় সুফিবাদের প্রভাব : ইসলামের অভ্যন্তরীণ মরমি বা বায়েনি দিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সুফিবাদী জীবনাদর্শ বাংলায় তার আধ্যাত্মিক চরিত্রকে অক্ষুণ্ন রেখেও বাঙালির জীবনধারায় তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। বাংলায় সুফিবাদের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও বহুমুখী তথা বাঙালির সার্বিক জীবনব্যাপী পরিব্যাপ্ত। বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐতিহ্য সাহিত্য ও মননে সুফিবাদ স্থায়ী প্রভাব ফেলে। নিয়ে বাঙালির জীবনাদর্শে সুফিবাদের প্রভাব আলোচনা করা হলো :
১. ধর্মীয় প্রভাব : সুফিবাদ বাংলার তৎকালীন প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে। প্রাক ইসলামি আমলে অর্থাৎ ইসলাম প্রচারের প্রাক্কালে এদেশের লোকেরা ছিল মূলত হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। এগারো শতকে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মদ বিন বস্তুতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর আরব, ইরান, তুরস্ক থেকে দলে দলে মুসলমান পীর, ফকির, দরবেশ, সুফিরা আগমন করতে থাকে। এসময় তাঁরা এদেশীয়দের মধ্যে ইসলামের তৌহিদের বাণী,
বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও শান্তির কথা প্রচার করতে থাকেন। সুফিদের আদর্শ চরিত্র অসাধারণ নৈতিক বল এবং দুঃস্থ মানুষের জন্য তাঁদের আন্তরিক সহানুভূতি ও সেবা বাংলার মানুষকে মুগ্ধ করে। সুফিদের জীবন চরিত্রের আকর্ষণীয়তায় মুগ্ধ হয়ে নিম্ন বর্ণের অনেক হিন্দু এবং বৌদ্ধরা ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়। এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য অনেক উচ্চবর্ণের হিন্দু ও ইসলাম গ্রহণ করে এ প্রসঙ্গে পর্তুগিজ পরিব্রাজক ছোঁয়াতে দ্য বারবোসা সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে ভ্রমণ করে তার বিবরণ লিখেছেন “এ দেশের বহু স্লেচ্ছ তাদের শাসকদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য প্রতিদিন ধর্মান্তরিত হচ্ছে।” তাই দেখা যায়, সুফিবাদ এদেশের মানুষের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল ।
২. সমাজ পরিবর্তন : বাংলায় প্রচলিত তৎকালীন সমাজ কাঠামো পরিবর্তনে সুফিবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোন নতুন জীবনাদর্শ বা শাসনের প্রতিষ্ঠা একটি সমাজের বিদ্যমান কাঠামো এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পবির্তন আনয়ন করে। বাংলায় সুফিবাদী জীবনাদর্শ অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাংলায় সুফিবাদ প্রচারের প্রাক্কালে বাংলার হিন্দুসমাজ নানা বর্ণে বিভক্ত ছিল। নিম্নবর্ণ বা শ্রেণির হিন্দুরা ছিল সামাজিকভাবে নির্যাতিত এবং অধঃপতিত অবস্থায় নিপতিত। এমনকি তাঁদের জন্য পূজা অর্চনা এবং বেদ পাঠ পর্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তাদের অনেক সামাজিক অধিকার পর্যন্ত রহিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী সাধারণ বৌদ্ধরাও সেন রাজাদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছিল। ফলে উভয় ধর্মের সাধারণ মানুষ মুক্তির জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েছিল। এ ঐতিহাসিক সময়ে সুফিদের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের বাণী এ সমস্ত লোকদের মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়। এর প্রভাবে তারা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। এতে শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষেরা ফিরে পায় তাদের অধিকার এবং অধিষ্ঠিত হয় সমাজের মর্যাদাপূর্ণ স্থানে। ফলশ্রুতিতে বিদ্যমান সমাজ। কাঠামোতে সূচিত হয় ব্যাপক পরিবর্তন।
৩. শিক্ষাবিস্তার : বাংলায় শিক্ষাবিস্তারেও সুফিদের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বাংলায় আগমনের পরই সুফিরা এদেশীয়দের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। সুফিরা এদেশে খানকা ও দরগা নির্মাণ করে বসবাস করতো। শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে তাঁরা এসব খানকা ও দরগার পাশে মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।তখনকার বাংলার শিক্ষাবিস্তারের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় বাঙালি সুফি দরবেশদের দ্বারা কোথাও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কোথাওবা
অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কখনোবা হাতে কলমে কখনোবা মুখে মুখে শিক্ষা প্রচার অব্যাহত ছিল। দিনাজপুর জেলার মাহিসন্তোষে প্রতিষ্ঠিত তকী উদ-দীনের মাদ্রসা, আবু তওয়ামা কর্তৃক সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা, রাজশাহীর বাঘায় প্রতিষ্ঠিত মাওলানা শাহ দৌলার মাদ্রাসা এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
৪. সাংস্কৃতিক প্রভাব : বাঙালির সংস্কৃতিতে সুফিবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলার নব্য সুফিবাদ একটি সমন্বয়ধর্মী মতবাদ। এতে হিন্দু ও বৌদ্ধ জীবন সংস্কৃতির সাথে ইসলামের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটে।ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠে এক নতুন সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা। সুফিদের সহজসরল, আদর্শিক ও আকর্ষণীয় জীবনযাত্রা ও বাঙালির সংস্কৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে। যেমন পীরবাদ প্রচলিত হিন্দুসমাজের গুরুবাদেরই নামান্তর। তাই দেখা যায় হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত নব্য মুসলিমরা পীরবাদকে গুরুবাদের সমার্থক বলে মনে করতো। হিন্দু আদর্শে এরা পীরের দরগায় লুট প্রদান করতো এবং সন্তানের রোগ নিরাময়ের কামনায় দরগায় পুষ্প অর্পণ করতো। আবার নবদীক্ষিত বৌদ্ধ মুসলমানগণ বৌদ্ধধাদর্শে প্রাণী হত্যা না
করে পীরের স্মরণে ছাগল, ভেড়া, মুরগি প্রভৃতি বনজঙ্গলে ছেড়ে দিতো। সুফি আদর্শের সাথে এদেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এরূপ আরও নানা প্রথা, আচার ও বিশ্বাসের উদ্ভব ঘটে।
৫. রাজনৈতিক প্রভাব : সূচনালগ্ন থেকে ষোল শতক পর্যন্ত সুফিবাদের তেমন কোন রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলেও সতেরো ও আঠারো শতকে সময়ের প্রয়োজনে সুফিবাদ রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করে। এসময়ে বাংলার কতিপয় সুফি দরবেশ এদেশের সাধারণ মানুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। জমিদার রাজন্যবর্গ, এমনকি ইংরেজ শাসকদের শাসনে বঞ্চিত, শোষিত, অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সুফিরা তাদের শক্তি দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, সংঘটিত করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুফি হাজী শরিয়ত উল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের সংগ্রাম এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৬. বাঙালির সাহিত্যে ও মনন সাধনায় সুফিবাদের প্রভাব : বাংলার সাহিত্য ও মনন বা দর্শনের ক্ষেত্রেও সুফিবাদ বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। সুফিবাদের প্রভাবে মধ্যযুগের বাংলার সাহিত্য ধারায় সুফি সাহিত্য নামে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। বাংলার সুফি সাহিত্যে আলোচিত হয়েছে সুফির যোগ চর্চা নির্ভর আধ্যাত্ম সাধনার কথা। এতে সন্ধান করা হয়েছে জীবনের শ্রেয় ও জগতের পরমসত্তার। বাঙালির দর্শন এবং মনন সাধনায়ও পড়েছে সুফিবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব। সুফিতত্ত্বের প্রভাবেই এদেশে বৈষ্ণব ও বাউল মতের সৃষ্টি হয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিসমাপ্তিতে বলা যায়, মধ্যযুগে বিকশিত সুফিবাদী আদর্শ বাঙালির জীবনদর্শনে যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই । বাঙালির দৈনন্দিন নিত্যনৈমিত্তিক জীবনাচারেও সুফিবাদ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এককথার বাঙালির সামগ্রিক জীবনধারা চালিত হয়েছে আপন মহিমায় ।