নব্য সুফিবাদের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ কর।

অথবা, নব্য সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধর।
অথবা, নব্য সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?
অথবা, নব্য সুফিবাদের কী কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে?
অথবা, নব্য সুফিবাদের বৈশিষ্ট্য বিষয়ে তোমার অভিমত কী?
অথবা, তোমার মতে নব্য সুফিবাদের কী কী বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়?
অথবা, নব্য সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
ধ্যান অনুধ্যানমূলক দার্শনিক চিন্তার পরিসরে মরমিবাদ একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কেবল ধর্ম নয়, ধর্মীয় চিন্তা এবং উচ্চতর ধর্ম অনুশীলনের পথে মরমিবাদের প্রভাব, অত্যন্ত সুস্পষ্ট ইসলামি চিন্তাধারা বা দর্শনে এ মরমিবাদই সুফিবাদ নামে খ্যাত। আর ইসলামের এ সুফিবাদী ভাবাদর্শের সাথে নিজস্ব চিন্তাধারার সংমিশ্রণে মরমিবাদের যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ধারাটি বাংলায় বিকাশ লাভ করে তাই নব্য সুফিবাদ ।
নব্য সুফিবাদ : সাধারণভাবে সুফিবাদ বলতে আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ণতা লাভের উপায়কেই নির্দেশ করা হয়। আর বাংলা হচ্ছে আধ্যাত্মিক ধ্যান অনুধ্যানমূলক চিন্তা তথা মরমিবাদের চারণভূমি। সহজসরল বাঙালির মনন ভূমিতে অতি প্রাচীন কালে বিভিন্ন অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ও প্রাচীন ধর্মসমূহকে আশ্রয় করে বাংলায় আধ্যাত্মবাদ সূচিত হলেও মধ্যযুগীয় বাংলায় বিশেষ করে তেরো শতকে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে ইসলামি মরমিবাদী চিন্তা বাঙালির মানসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। এ সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে সুফি সাধকেরা উল্লেখযোগ্য হারে বাংলায় আসেন এবং এদেশীয়দের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকে। এঁদের প্রভাবে বাংলা ভূখণ্ডের নানা জাতির মানুষেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম, সংস্কার, প্রথা রীতিনীতি, সাধনা ইত্যাদি একেবারে বর্জন করতে পারেননি। এতে শুরু হয় গ্রহণ বর্জনের পালা। ফলে বাঙালির চিন্তা চেতনায় যেমন সুফিবাদের প্রভাব পড়ে তেমনি সুফিবাদও বাঙালির চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্টি লাভ করে। এগারো শতক থেকে শুরু করে পনেরো শতক পর্যন্ত বাংলায় সুফিবাদ তার মূল আদর্শ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারলেও ষোল শতক হতে এদেশীয় পারস্পরিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে চিশতিয়া, কলন্দারিয়া, মাদারিয়া, কাদারিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সুফি সাধক ও বাংলার বাঙালি সুফিদের দ্বারা এক নতুন ধর্ম ও দার্শনিক আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করতে থাকে। ড. এনামুল হক বাংলায় বিকশিত সুফিবাদের এ নতুন রূপটিরই নাম দেন নব্য সুফিবাদ ।
নব্য সুফিবাদের বৈশিষ্ট্য : বাংলায় বিকশিত নব্য সুফিবাদ সুফিবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে ধারণ করার পাশাপাশি কতকগুলো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকেও ধারণ করে। নিম্নে নব্য সুফিবাদের এ সকল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো :
১. আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস : নব্য সুফিবাদ আদি সুফিবাদের আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করার মৌলিক বৈশিষ্ট্যটিকে মনেপ্রাণে ধারণ করে। কুরআন ও হাদিসভিত্তিক একত্ববাদকে নব্য সুফিবাদ আঁকড়ে ধরে। অর্থাৎ বাংলায় সুফিবাদ নানা গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়নি।
২. সমন্বয় ধর্মী মতবাদ : নব্য সুফিবাদ একটি সমন্বয় ধর্মী মতবাদ বাইরে থেকে আগত সুফিবাদী ভাবাদর্শের সঙ্গে দেশীয় ভাবধারা তথা দেশজ লোকজ ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, প্রথা, তন্ত্র, যোগ, সেই সাধনার সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলার নব্য সুফিবাদ।
৩. পীর বা গুরুবাদী : নব্য সুফিবাদ ইসলামি সুফি আদর্শের সাথে সংগতি রেখে পীর বা গুরুবাদী বিশ্বাস দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। এখানকার সুফিরা বিশ্বাস করে আল্লাহর সত্যিকারের উপলব্ধির জন্য পীরের সাহায্য প্রয়োজন। বাংলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সুফি পীরের দরগা বা মাজার এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
৪. লোকায়ত মতবাদ : নব্য সুফিবাদ একটি লোকায়ত মতবাদ। কেননা, সুফিবাদের সঙ্গে বাঙালির প্রচলিত লৌকিক মতবাদের সংমিশ্রণের মধ্য দিয়েই নব্য সুফিবাদ পূর্ণতা লাভ করে।
৫. বিশ্বজনীন : বাংলায় বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সুফিরা বয়ে নিয়ে এসেছিলেন বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বাণী। এ বাণীই আকৃষ্ট করেছিল বাঙালির মনন ও ধ্যানধারণাকে। ফলে সুফিদের উদারতা, মহানুভবতা, মানবিকতা বাংলার সুফি দর্শনকে বিশ্বজনীন করে তুলে।
৬. অনৈসলামিক ভাবধারার প্রভাব : বাংলায় নব্য সুফিবাদ কমবেশি অনৈসলামিক ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত। উদাহরণস্বরূপ সুফিবাদে অনুপ্রবেশিত পীর পূজা, কবর, পূজা, দরগা সজ্জা, মানত করা ইত্যাদির কথা বলা যায়।
৭. মানবতাবাদী : উদার ও মানবতাবাদী চিন্তাধারা সুফিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলায় বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সুফিরা বর্ণবৈষম্য, জাতি রভেদ ইত্যাদির পরিবর্তে মানুষে মানুষে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ফলে সুফি ভাবাদর্শ এদেশে বিকাশের সাথে সাথে মানবতাবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে।
৮. দেহকেন্দ্রিক সাধনা : এদেশীয় যোগ ও তন্ত্র প্রভাবিত দেহকেন্দ্রিক সাধনার প্রভাবে নব্য সুফিদের আধ্যাত্মিক সাধনায় দেহ সাধনা অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠে। নব্য সুফিদের মতে, দেহের মধ্যেই প্রেমাস্পদ আল্লাহকে অনুসন্ধান করতে হবে। তাই নব্য সুফিরা দেহের দশটি স্থানের প্রতি মনোযোগ দিয়ে জিকির করেন।
৯. প্রেমবাদী : প্রেমই নব্য সুফিবাদী দর্শনের প্রাণশক্তি। তবে দেহ বা মানবিক প্রেম নয় ঐশী বা খোদা প্রেমেই তাদের আসক্তি। মানসিক প্রেমকে তাঁরা ঐশী প্রেমের সোপান বলে গণ্য করেন।
উপসংহার : অবশেষে বলা যায়, নব্য সুফিবাদ আদি সুফিবাদের মূল উৎস থেকে উৎসারিত হলেও দেশীয় লোকজ ভাবধারার সংমিশ্রণে তা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে উঠে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*