দেবেন্দনাথ ঠাকুর এবং ইয়ং বেঙ্গলের বিশেষ উল্লেখপূর্বক বেঙ্গল রেনেসাঁর মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইয়ং বেঙ্গলের বিশেষ উল্লেখপূর্বক বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
সভ্যতার ইতিহাসে রেনেসাঁ একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। রেনেসাঁ শব্দের অর্থ হলো পুনর্জন। সাধারণত রেনেসাঁ বলতে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতি সম্পর্কে জানবার এক অদম্য উৎসাহ বোঝায়। রেনেসাঁর প্রভাবে উনিশ শতকে বঙ্গদেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। যদিও উভয় রেনেসাঁর মধ্যে সময়ের ব্যবধান রয়েছে। পাশ্চাত্য রেনেসাঁর প্রভাব বলতে রেনেসাঁর
প্রভাবে যে জ্ঞানের জগতে পরিবর্তন আসে তার দ্বারা বাঙালি দর্শন প্রভাবিত এরূপ বোঝায়। কতিপয় ব্রিটিশ ও বাঙালি বিজ্ঞজনদের যোগাযোগ সংশ্লেষের ফলে বাঙালি রেনেসাঁর উদ্ভব।
রেনেসাঁ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রেনেসাঁ পরবর্তী বাঙালি দার্শনিক। পারিবারিক পরিবেশে তিনি যে শিক্ষা লাভ করেন তা তার দার্শনিক চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি প্রথম জীবনে বৈরাগ্য পথ অনুসরণ করেন। তার মধ্যে ধর্মভাব প্রবল হয়ে ওঠে। তিনি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন এবং পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করেন। তত্ত্বালোচনার জন্য তিনি ১৮৩৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীত এ সভা তত্ত্ববোধিনী সভা নামে পরিচিত হয়। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার পরিহার করে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মানবতাবাদের আদর্শকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ধর্মের লক্ষ্য হিসেবে ব্রহ্ম লাভকে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসনা বা প্রার্থনার নিয়মাবলি তৈরি করেন।
রেনেসাঁ ও ইয়ং বেঙ্গল : উনিশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম একজন পথিকৃত হলেন ডিরোজিও। তার নেতৃত্বে কলকাতার হিন্দু কলেজের শিক্ষক-ছাত্র বাংলায় কুসংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। ডিরোজিও তার ছাত্রদের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আদর্শকে ছড়িয়ে দেন। তার অনুসারীরা প্রগতিশীল ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত। ইয়ং বেঙ্গলেরা পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধ্যানধারণাকে আত্মস্থ করেন। তারা বাঙালির বিশ্বাসের জগৎ, সামাজিক কুসংস্কার দূর করার প্রচেষ্টা করেন। বাঙালি ধর্ম ও সমাজকে পরিবর্তন করার প্রয়াস চালান। এজন্য তারা একাডেমিক এসোসিয়েশন গড়ে তোলেন।এর মাধ্যমে তারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন। ইয়ং বেঙ্গলরা ছিলেন যুক্তিবাদী। যুক্তির কষ্টি পাথরে যা ভালো বলে মনে হয়েছে তাই তারা গ্রহণ করেছেন এবং যা মন্দ বলে মনে হয়েছে তাই তারা বর্জন করেছেন। তাদের মন ছিল সংস্কারমুক্ত।আলোচনা পদ্ধতি ছিল যুক্তি-বুদ্ধি এবং ধ্যানধারণা ছিল প্রগতিশীল। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এরূপ, “সব কিছুর প্রতি সন্দিহান হও, অনুসন্ধান করে সংশয় নিরসন করে, তথ্য পর্যবেক্ষণ করে সত্য নির্ণয়ে তৎপর হও, নির্ণীত সত্য যখন বাস্তবের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত অবস্থায় কার্যকরী থাকে না তখন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কে সন্দিহান হও এবং এভাবে সংশয় অনুসন্ধান কর্ম অন্তহীন ধারায় চালিয়ে যাও।”
বেঙ্গল রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য : উনিশ শতকে বাঙালি সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম তথা জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে যে ভাব-বিপ্লব সংঘটিত হয় তাকে বেঙ্গল রেনেসাঁ বলা হয়। বেঙ্গল রেনেসাঁর কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ঐসব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে বাঙালির মনোজগৎ, শিল্পকলা, সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব তথা তাদের সামগ্রিক জীবনে। নিম্নে বেঙ্গল রেনেসাঁর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :
১. মানবতাবাদ : বেঙ্গল রেনেসাঁর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবাদ। রেনেসাঁর পণ্ডিতগণ তাদের ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে এবং সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ধ্রুপদী সাহিত্যে মানুষকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে।
২. ব্যক্তিত্বের বিকাশ : বেঙ্গল রেনেসাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিত্বের বিকাশ। রেনেসাঁর মাধ্যমে স্বাধীনভাবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটেছে। ব্যক্তিত্বের বিকাশের চিত্র সর্বত্রই লক্ষণীয়। বেঙ্গল রেনেসাঁয় রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ চিন্তাবিদদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশের বিষয়টি লক্ষণীয়। তাদের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যানধারণা, কর্মকাণ্ড উন্নত ব্যক্তিত্ব নির্দেশ করে। তাদের ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত সুসংহত ও সুবিকশিত হওয়ার কারণে তাদেরকে পরবর্তী চিন্তাবিদগণ অনুসরণ করেছেন। তারা নিজেরাও উন্নত ব্যক্তিত্ব গঠনে কাজ করেছেন সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য।
৩. যুক্তিবাদিতা : রেনেসাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার বিকাশ। রেনেসাঁর পণ্ডিতগণ সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে যুক্তির সাহায্য গ্রহণ করেন। তারা যুক্তির আলোকে সমাজ ও ধর্ম থেকে কুসংস্কার দূর করতে জনমত গঠন করেছেন। রামমোহন রায় রেনেসাঁর পণ্ডিত হিসেবে সর্বপ্রথম যুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ করেন। পরবর্তীতে চিন্তাবিদদের মধ্যেও যুক্তিবাদিতার পরিচয় পাওয়া যায়।
৪. অসাম্প্রদায়িকতা : বেঙ্গল রেনেসাঁ বাঙালি চিন্তাবিদদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণার বিকাশ ঘটায়। পাশ্চাত্যের অনুকরণে তারা ধর্মীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন এবং সমাজের প্রতিটি মানুষের কল্যাণে কাজ করেন।
৫. জীবনমুখী সাহিত্য রচনা : রেনেসাঁর পণ্ডিতগণ আধ্যাত্মিক, ধর্মীয়, ব্যাখ্যাধর্মী সাহিত্য রচনার পরিবর্তে জীবনমুখী বাস্তববাদী সাহিত্য রচনা করেন। তাদের সাহিত্যে মানুষ, মানবতা, জীবন ও জীবনের সংকট, মানবিক মর্যাদা প্রভৃতি প্রাধান্য পেয়েছে।
৬. বিজ্ঞানমনস্কতা : রেনেসাঁর প্রভাবে বাঙালি চিন্তাবিদদের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতা বৃদ্ধি পায়। তারা পাশ্চাত্যের আদলে সবকিছুকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেন। তারা সবকিছুকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেন এবং তাদের রচনায় এর প্রকাশ ঘটান। অক্ষয়কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ দার্শনিকদের মধ্যে বিজ্ঞানপ্রীতি সর্বাধিক লক্ষণীয়।
৭. কুসংস্কারের বিরোধিতা : রেনেসাঁর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, রেনেসাঁর পণ্ডিতগণ সকল প্রকার ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছেন।
৮. শিক্ষার প্রসার : রেনেসাঁর মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটে। ক্রমশ পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি থেকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। হিন্দু কলেজ, ফোর্টউইলিয়াম কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা শিক্ষা প্রসারেরই সাক্ষ্য বহন করে। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা বিষয়ক কর্মসূচি তারই সাক্ষ্য বহন করে।
৯. নারীর কল্যাণ : রেনেসাঁর সময় নারীকে তার অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। বাল্য বিবাহ, কৌলিণ্য প্রথা, সতীদাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখা যায়। এছাড়া নারী শিক্ষা প্রসারেও নানা কর্মসূচি চোখে পড়ে।
১০. ধর্ম সংস্কার : রেনেসাঁর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো রেনেসাঁর পণ্ডিতগণ প্রচলিত হিন্দুধর্মের নানা দিক ও কুসংস্কার নিয়ে আলোচনা করেন। রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ ধর্ম সংস্কারে বিশেষ অবদান রাখেন। রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্ম, অক্ষয়কুমার দত্তের অনুশীলন ধর্ম তারই পরিচয় বহন করে। তারা যুক্তির আলোকে ধর্মকে বিশুদ্ধ রূপ দিতে চেয়েছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, রেনেসাঁ শুধু বাঙালি সমাজকে নয় বরং সমগ্র বাঙালি জীবন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। রেনেসাঁর মাধ্যমেই বাঙালি জাতি তার আপন সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায়। বেঙ্গল রেনেসাঁ বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছে যুক্তিবাদী ও কুসংস্কারমুক্ত, বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী জীবনমুখী সমাজব্যবস্থা রচনার শক্তি। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে উদ্ভাসিত করেছে জ্ঞানের আলোয়। মানুষ ও মানবিক মর্যাদা স্থান পেয়েছে যথাযথ স্থানে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%82-%e0%a6%ac%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*