‘ডাহুক’ কবিতায় ফররুখ আহমদের বেদনা ভারাক্রান্ত যে কবিসত্তার প্রকাশ ঘটেছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘ডাহুক’ কবিতায় মানবজীবনের যে বেদনার কথা ব্যক্ত হয়েছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর
উত্তর৷ ভূমিকা :
একজন সম্পূর্ণ কবিসত্তার অধিকারী হয়েও ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) শুধুই কবি ছিলেন না। রূপ ভাবকে অবলম্বন করে গড়ে উঠে ভাব, জাগে ভালোবাসা। ফররুখ আহমদের এ ভালোবাসা মানবতা কেন্দ্রিক। আর যেহেতু ইসলাম মানবপ্রীতি আশ্রয়ী, তাই ফররুখ আহমদ ইসলামকে ভালোবেসেছিলেন। ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদ। ‘ডাহুক’ ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট গভীর জীবনবোধের একটি অনন্য কবিতা।
কবির মানসচেতনা : ফররুখ আহমদ মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী কবি। ইসলামের আদর্শ এবং আরব ইরানের ঐতিহ্য তাঁর কবিতায় উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত। ইসলামের মহান আদর্শের মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মানবতার মুক্তির সোপান। ইহলৌকিক এবং পরলোকিক কল্যাণের জন্য তিনি একমাত্র স্রষ্টার সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করেছেন। প্রেম ও রোমান্টিকতার কবি ফররুখ আহমদের চেতনালোকে সব সময় ছিল এক অদৃশ্য শক্তির প্রতি আসক্তি।
‘ডাহুক’ কবিতায় কবিসত্তার প্রকাশ : ‘ডাহুক’ কবিতায় কবির অতৃপ্ত বেদনাদীর্ণ কবিসত্তার প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইসলামি ভাবাদর্শে আবদ্ধ কবি ‘ডাহুক’কবিতার মাধ্যমে পৌঁছেছেন এক নিজাগতিক চেতনায়। কবি জৈবিকতার বন্ধন ছিন্ন করে আত্মশুদ্ধি ও আত্মনুশীলনের মাধ্যমে পরম প্রভুর সান্নিধ্য লাভের ব্যাকুল ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ‘ডাহুক’ কবিতায়। কিন্তু কবি জানেন ডাহুক যা পারে মানুষ তা পারে না। আত্মনিবেদনে মানুষ কপট।


“ঘুমের নিবিড় বলে সেই শুধু সজাগ প্রহরী

চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন পরী।”


আত্মমুক্তির প্রেরণা : ডাহুকের স্তব্ধবিদারী ডাক কবি চেতনায় বয়ে নিয়ে আসে মুক্তির বার্তা। ডাহুকের সুর মদিরায় কবির চেতনার মূল থেকে উঠে আসে এক ভাবাচ্ছন্ন প্রেরণা। ডাহুক তার সঙ্গীর খোঁজে সেভাবে একনিষ্ঠতায় ডাকতে পারে, মানুষ পরম স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের জন্য কেন একনিষ্ঠ হতে পারে না তা কবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ডাহুকের ডাকে কবি খুঁজে পান অসীম স্রষ্টার মুক্তির আহ্বান।


ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে
অশান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে স্বপ্নের প্রবাল।”


অধ্যাত্ম চেতনার প্রকাশ : বস্তুজগতের অন্তরালে মানবমনে সবসময় খেলা করে যায় নির্জাগতিক চেতনা। সবকিছু থেকেও কী যেন এক না থাকার অনুভূতি; সবকিছু পেয়েও না পাওয়ায় এক গভীর অতৃপ্তিবোধ মানবাত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। সে আশ্রয় খোঁজে মহান কোন সত্তার মাঝে। ডাহুকের সুর কবির কাছে তেমনি মহান মুক্তির বাণী হিসেবে দেখা দিয়েছে। অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন- “স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ভারাক্রান্ত কবি চিত্তের আর্তনাদ যেন ভাষা পেয়েছে ডাহুক কবিতায়। স্বপ্ন ও বাস্তবের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত প্রকাশ ব্যাকুল কবি আত্মায়ই যেন কথা বলে উঠেছে।”
চেনা অচেনার দ্বন্দ্ব : দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’ কবি বর্ণিল শরীরীরূপে ডাহুককে চিনলেও তার সুর কবির অচেনা। শরীরী অস্তিত্বের ভিতর থেকে উঠে আসে যে সুরধ্বনি তা কবির কাছে দুর্ভেয় দুর্বোধ্য মনে হয়। কবি নিজের দৈহিক রূপটিকেই জানেন কিন্তু জানেন না তাঁর আত্মার রূপটি কেমন।
অসীমের সন্ধানে : ডাহুকের ডাককে কবি দেখেছেন অসীম স্রষ্টার অমোঘ বারতা হিসেবে। ডাহুকের সুর কবির চেতনায় এক অশরীরী সত্তার আহ্বান হিসেবেই প্রতিধ্বনিত হয়। ডাহুকের একনিষ্ঠতায় কবি নিজের ত্রুটিগুলো বুঝতে পারেন। মানুষের জীবন জৈবিকতা ও সংসারধর্ম নানা জটিলতায় পূর্ণ। কবি ডাহুকের মতো পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত হতে চান কিন্তু পারেন না।

“এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও,.

তুবও তোমার শৃঙ্খলমুক্ত পূর্ণচিত্তে জীবন মৃত্যুর
পরিপূর্ণ সুর।”


পাওয়া না পাওয়ার বেদনাবোধ : সব পেয়েও না পাওয়ার বেদনায় বিদীর্ণ, সব থাকতেও কিছুই না থাকার অসীম শূন্যতা আধ্যাত্মিক চেতনার মূল কথা। ডাহুকের স্তব্ধবিদারী ডাকে কবির অতৃপ্তির গ্লানি ফেনিল হয়ে উঠে। কবি জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মিলাতে গিয়ে বেদনায় নীল হয়ে পড়েন। মানুষের কদর্যপূর্ণ জীবনে সবসময় অতৃপ্তি বিরাজ করে। সে মুক্ত পাখি, ডাহুকের মতো তার ভালোবাসার পাত্রকে ডাকতে পারে না। সে অসম্পূর্ণ। তার চাওয়া-পাওয়ার ভিতর সবসময় কাজ করে স্বার্থপরতা। তার বেদনাদীর্ণ হৃদয় শান্তির পরশ খুঁজে পায় ডাহুকের ডাকে। মগ্ন চৈতন্যে কবি তাই বলেছেন-


“হে পাখি হে সুরাপাত্র! আজো আমি চিনিনি তোমাকে।”


কবির অনুভূতি : অন্ধকারে নিমজ্জিত দুর্দশাগ্রস্ত জাতির অবস্থা দেখে কবিহৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে। কবি দেশ জাতি ও নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন বাস্তবজীবনে তা রূপায়িত হয়নি। পাশাপাশি তিনি অন্তর্ধানে পরমস্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করেছিলেন তাও জৈবিকতার দংশনে ফলবতী হতে পারেনি। কবি অনুভব করেন, তিনি যে জীবনে শিকল পরে আছেন তাতে পরমাত্মার সন্ধান লাভ করা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তিনি তখন ডাহুকের উদ্দেশ্যে বলে উঠেন-


“শুনিয়া তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।”


উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ডাহুকের অনুষঙ্গে কবির হৃদয়ের এক চরম অতৃপ্তি ফুটে উঠেছে। কবির অধ্যাত্মচেতনা ডাহুকের শরীরসত্তাকে আশ্রয় করে প্রকাশিত হয়েছে। কবি আপন সত্তায় যে আদর্শের অনুধ্যান করেছেন তা খুঁজে পেয়েছেন একমাত্র ডাহুকের মধ্যে। মুক্তপক্ষ ডাহুক তাই কবির কাছে আদর্শ। ডাহুকের মতো একনিষ্ঠতায় কবিও স্রষ্টাকে ডাকার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!