ডক্যুমেন্ট স্টাডি সম্পর্কে যা জান আলোচনা কর ।
অথা, গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি হিসেবে ডক্যুমেন্ট স্টাডি সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, ডক্যুমেন্ট স্টাডির সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর।
অথবা, ডক্যুমেন্ট স্টাডির শ্রেণিবিভাগ উল্লেখপূর্বক এর সুবিধা ও অসুবিধা বর্ণনা কর।
অথবা, ডক্যুমেন্ট স্টাডির ধরনসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, ডক্যুমেন্ট স্টাডির সবল ও দুর্বল দিক আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ডক্যুমেন্ট স্টাডিতে তথ্যের উৎস হিসেবে প্রচলিত বা বিদ্যমান তথ্যকে ডক্যুমেন্ট হিসেবে ধরে নেয়া হয়। গবেষকরা তথ্য সংগ্রহের কৌশল হিসেবে পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার, প্রশ্নপত্র ইত্যাদিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেন, সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন অথবা উদ্দেশ্যভিত্তিক লিখিত প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করেন। কিন্তু ডক্যুমেন্ট পদ্ধতির ক্ষেত্রেও ব্যক্তিবর্গ তথ্যের উৎস হিসেবে প্রচলিত বা উপস্থিত তথ্যকে ডক্যুমেন্ট বিবেচনা করা হয় ।
ডক্যুমেন্টের প্রকারভেদ : ডক্যুমেন্ট বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অবস্থায় ও মালিকানায় বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায়। ডক্যুমেন্ট স্টাডিকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো : ১. পরিসংখ্যান রেকর্ড, ২. সংরক্ষিত জরিপলব্ধ তথ্য, ৩, লিখিত রেকর্ড।
১. পরিসংখ্যান রেকর্ড : বিভিন্ন সময় বহুবিধ শ্রেণি, সমাজ, বয়স, লিঙ্গ, পারিবারিক আকৃতি, পেশা, বাসস্থান, ধর্ম ও জন্মমৃত্যসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যা সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি সভ্য সমাজই তার সদস্যদের বিভিন্ন আচরণের পরিসংখ্যানগত
তথ্য কোনো না কোনোভাবে সংরক্ষণ করে আসছে। এ পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সময় ও অর্থ দুটিই কম ব্যয় হয়। এ ধরনের রেকর্ডে সরকারিকভাবে লোক গণনা, কেন্দ্রীয় আঞ্চলিক ও বিভাগীয় প্রশাসনে সংরক্ষিত জনমিতিক তথ্যাবলি এবংm বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও দলের সংরক্ষিত নিজস্ব সদস্য সম্পর্কিত তথ্যাবলি এখানে উল্লেখ থাকে ।
২. সংরক্ষিত জরিপলব্ধ তথ্য : সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আলোকে পরবর্তী গবেষণা কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তার গবেষণালব্ধ তথ্য বা জরিপকৃত তথ্যাবলি উপযুক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে সংরক্ষণ করে থাকেন। প্রতিটি পরিকল্পনা প্রণয়ন, পরিচালনা ও মূল্যায়নকালে একাধিক অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করা হয়, যার একটি প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য থাকে অনুসন্ধানলব্ধ ফলাফল বা তথ্য সমধর্মী উপযোগসমূহ ব্যবহৃত হওয়া। কম্পিউটার আবিষ্কারের মাধ্যমে এসব জরিপের তথ্য উত্তমরূপে সংরক্ষণ করা সুবিধাজনক। ফলে এর ব্যবহার ব্যাপক। উদাহরণ ICDDRB. বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, BIDS, SSRC, বেনবেইজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান তথ্য সংরক্ষণ করে ।
৩. লিখিত রেকর্ড : পরিসংখ্যান রেকর্ড এবং সংরক্ষিত জরিপ তথ্য ছাড়া অন্যান্য যেসব লিখিত উৎস হতে সমাজ গবেষক তথ্য সংগ্রহ করেন, সেগুলো এককভাবে লিখিত রেকর্ড হিস বে বিবেচিত হয়। এগুলো সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
ক. সরকারি ও বেসরকারি ডক্যুমেন্ট : Navins উল্লেখ করেছেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বস্তুত সরকারি পর্যায়ে এ ধরনের তথ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। যথা : কেস রেকর্ড, তদন্ত রিপোর্ট, বিচার বিভাগীয় রিপোর্ট ইত্যাদি । এমনভাবে বেসরকারি পর্যায়েও বিভিন্ন বর্ণনা ও বিবৃতিমূলক তথ্যাবলি সংরক্ষণের প্রবণতা ও উপস্থিতি সবসময়ই সব সমাজে লক্ষ করা যায় ।
খ. গণযোগাযোগ মাধ্যম : পরিসংখ্যান রেকর্ড, সংরক্ষিত জরিপদ্ধতি তথ্য এবং আত্মচরিত ছাড়াও যে কোনো সভ্য সমাজে সাধারণ জনগণকে অবহিত ও পরিচিত করানোর জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এগুলো হলো সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জার্নাল এবং অধুনা ব্যবহৃত চলচ্চিত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ই-মেইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি ।
ডক্যুমেন্ট স্টাডির সুবিধা : সুবিধাগুলো নিম্নরূপ :
১. অসাম্য ও দুষ্প্রাপ্য বিষয়াদি : যেসব অবস্থা বা বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান কাজে গবেষকের দৈহিক প্রবেশাধিকারm সম্ভব নয়, সে সব বিষয়ের উপর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ডক্যুমেন্ট উপযোগী তথ্য সংগ্রহ মাধ্যম ।
২. প্রতিক্রিয়াহীনতা : অনুসন্ধানটি একমুখী হওয়ার কারণে উত্তরদাতার প্রতিক্রিয়া বা অন্য কোনো প্রভাব পড়ে না ।
৩. অনুকল্প গঠন ও তুলনা : উপস্থিতি ডক্যুমেন্ট সামাজিক গবেষণার অনুকল্প গঠনে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ, করে । আবার বিভিন্ন সামাজিক অবস্থার তুলনামূলক সমীক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করে ।
৪. নমুনা আকার : এ পদ্ধতিতে বিস্তৃত এলাকায় নুমনা নিয়ে জরিপের কাজ করা যায় ।
৫. উন্নতমান : কিছু কিছু ডক্যুমেন্ট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, ফলে প্রাপ্ত তথ্যও উন্নতমানের হয় ।
৬. ঐতিহাসিক পদ্ধতি : এটি ঐতিহাসিক বিষয় গবেষণার একমাত্র পদ্ধতি ।
৭. স্বতঃস্ফূর্ততা : প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মতো এখানেও স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রাথমিক তৎপরতা বা অনুভূতি ধারণ করা যায়। যথা : আত্মচিরত, রোজনামচা, চিঠিপত্র ইত্যাদি ।
৮. স্বীকারোক্তি : প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে ব্যক্তির অনেক সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু রোজনামচা, আত্মচরিত, আত্মহত্যাপত্র ইত্যাদিতে সত্য ঘটনা নিহিত থাকে ।
৯. সাশ্রয় : এখানে তুলনামূলক খরচ ও সময় কম লাগে।
১০. গোপনীয়তা রক্ষা : উত্তরদাতার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ করার চেয়ে ডক্যুমেন্ট ব্যবহারে যাবতীয় গোপনীয়তা রক্ষা করা সুবিধাজনক ।
১১. দীর্ঘস্থায়ী : প্রয়োজন হলে দীর্ঘসময় ধরে গবেষণা কাজ চালনা করা হয় তবুও কারও বিরক্তি হয় না ।
ডক্যুমেন্ট স্টাডির অসুবিধা : এ পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ হলো :
১. পক্ষপাত : গবেষণা ছাড়াও অন্য কারণে ডক্যুমেন্ট সংরক্ষণ করা হয় বলে পক্ষপাতিত্ব দেখা দেয় ।
২. ক্ষণস্থায়িত্ব : অনেক ডক্যুমেন্ট যেমন-প্রাচীন পুঁথি, জীবনচরিত, চিঠিপত্র ইত্যাদি এমনভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় যার দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ দুষ্কর ।
৩. অসম্পূর্ণতা : উদ্দেশ্যে ভিত্তিতে অনেক সময় ডক্যুমেন্ট অসম্পূর্ণ থাকে ।
৪. দুস্প্রাপ্যতা : অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনেক সময় কোনো ডক্যুমেন্টই পাওয়া যায় না বলে সংরক্ষণ করা হলেও তা ধ্বংস হয়ে থাকে ।
৫. নমুনায়নগত সীমাবদ্ধতা : যেহেতু একমাত্র শিক্ষিত শ্রেণিই ডক্যুমেন্ট প্রণয়ন ও গঠনে সক্ষম, তাই অশিক্ষিত অংশের সাথে বৃত্তের নমুনায়ন সম্ভব নয়।
৭. মানসম্মত ছকের অভাব : অনেক ডক্যুমেন্ট মানসম্মত ছকের ভিত্তিতে তৈরি হয় না।
৮. ভাষাগত সীমাবদ্ধতা : ডক্যুমেন্ট সাধারণত মানুষের ভাষাগত আচরণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। এগুলো অন্যান্য আচরণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনো তথ্য প্রদান করে না ।
৯. সাঙ্কেতীকরণ সমস্যা : এ পদ্ধতি বর্ণনাত্মক হওয়ার কারণে সংখ্যায়ন করা যথেষ্ট কষ্টকর।
১০ .সময়গত তুলনা : এ স্টাডি দীর্ঘ সময়ের তারতম্যেই শুধু তুলে ধরতে পারে। কিন্তু এক্ষত্রে অন্যান্য পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে পারে না ।
১১. সহায়ক বিষয়াবলির অভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ডক্যুমেন্ট স্টাডি সাম্প্রতিকালে কিছু গবেষণার একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে। এ পদ্ধতি ডক্যুমেন্টর কার্যকারিতার উপর নির্ভরশীল বলে সংশ্লিষ্ট সবারই উচিত গবেষণার প্রয়োজনে বিভিন্ন ডক্যুমেন্ট মানসম্মত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করা এবং তার ব্যবহার নিশ্চিত করা। সবশেষে বলা যায় যে, এ পদ্ধতি বর্তমানে বেশি উপযোগী ভূমিকা পালন করে থাকে ।