Answer

জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার যে সমন্বয় সাধিত হয়েছে তার বিবরণ দাও।

উত্তর ভূমিকা : আঙ্গিক ও বিষয়ের দিক থেকে জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) ‘বনলতা সেন’ একটি ক্ষুদ্র স্ফটিক স্বচ্ছ গীতি কবিতা মাত্র। কিন্তু ভূগোলের বিস্তৃতি ও ইতিহাসের বেদ পারস্পরিক সমন্বয়ে কবিতাটির আয়তনের যে সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে তাতে কবিতাটিতে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি সঞ্চারিত হয়েছে বলে কাব্য সমালোচকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মহাকাব্যের ব্যাপ্তি ধারণকারী এ আশ্চর্য গীতি কবিতাটির মর্মে রয়েছে প্রেমের মৃত্যুঞ্জয়ী অনুভব। শাশ্বতকালের প্রেম পিপাসা প্রশান্তির স্নিগ্ধ স্পর্শে এখানে হয়ে উঠেছে মহিমাময়। হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় অগণিত জন্মের চারপাশে কবি দেখেছেন মৃত্যুর সফেন সমুদ্র। আর সে সফেন সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করেছেন, প্রেমের অভিজ্ঞতাই শুধু অনির্বাণ হয়ে জেগে থাকে। আর বাকি সবকিছুই ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
প্রেম পিয়াসী পুরুষ সত্তা : প্রেমের আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। প্রেমের সন্ধানে মানুষ সংসার ছাড়ে, অনিশ্চিত পথের যাত্রী হয় এবং প্রয়োজনে উৎসর্গ করে আপন জীবনকে। প্রেমহীন জীবন মানুষের কাছে ‘রুক্ষ মরুসম’ এবং ‘মরণের অধিক মরণ’। জীবনকে ভালোবেসেই মানুষ তাই সন্ধান করে ‘মানবের তরে এক মানবীয় হৃদয়’। এ সন্ধানে যখন সে ব্যর্থ হয়, তখন হতাশা আর বেদনার অন্ধকারে ঢেকে যায় তার সমগ্র জীবন। কিন্তু যখন সে মুখ দেখে সফলতার, তখন তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে দারুচিনি দ্বীপের ভেতর এক সবুজ ঘাসের দেশ। তার জীবন তখন হয় পূর্ণ ও সার্থক। প্রেমের সন্ধানে নিত্যকালের পুরুষ সত্তার প্রতিনিধি হয়ে কবি পথে নেমেছেন। অতিক্রম করে এসেছেন হাজার বছরের পথ।
সৌন্দর্যময়ী ও প্রেমদাত্রী নারীসত্তা : কবির ‘বনলতা সেন’ চিরকালের প্রেমময়ী নারীর এক আশ্চর্য মনোহর প্রতিমা। প্রাণের অকৃপণ ঐশ্বর্যে সে সমৃদ্ধ। তাই মুহূর্তেই সে সঞ্জীবিত করে তোলে হাজার বছরের ক্লান্তিতে জরজর পুরুষ সত্তাকে। যে প্রেমময়ী নারীর সন্ধানে পুরুষ সত্তা অতিক্রম করে ইতিহাস আর ভূগোলের বিস্তীর্ণ চড়াই উৎরাই ভরা পথ, ছুটে চলে দেশ থেকে দেশাত্তরে, এক অজানা থেকে আরেক অজানায় বনলতা সেন সে বাঞ্ছিতা নারীর সবটুকু প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ধারণ করে আছে তার দেহমনে। তার চোখ পাখির নীড়ের মতো। তাই নীড় সন্ধানী পথবাসী পুরুষ সত্তা খুব সহজেই সেখানে খুঁজে পায় নীড়ের নিরাপদ আশ্রয়। তার চুল বিদিশার রাত্রির মতো নিকষ কালো যা একই সঙ্গে প্রশান্তি ও মাদকতা জাগায় পুরুষ সত্তায়। তার মুখশ্রীতে পাওয়া যায় ত্রিকোণ ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত অপূর্ব স্থাপত্য সৌকর্যে সমৃদ্ধ নগর শ্রাবস্তীর কারুকাজের আভাষ।
প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার সমন্বয় : প্রেমের শাশ্বত অনুভবে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি। এখানে প্রেম চেতনার সঙ্গে চমৎকারভাবে মিশেছে প্রকৃতি চেতনা। প্রেম ও প্রকৃতি এখানে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলেছে, হয়ে উঠেছে একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে না এলে প্রেম যে পরিপূর্ণ হতে পারে না জীবনানন্দ দাশ অনেকটা নতুনভাবেই তা আমাদের শিখিয়েছেন। উপমা আহরণ করেছেন তিনি প্রকৃতি থেকে, পূর্ণতা ও প্রশান্তির জন্যও বার বার ফিরে তাকিয়েছেন প্রকৃতির দিকে এবং প্রকৃতিকে নতুনভাব  দেখবার চোখ খুলে দিয়েছেন তাঁর পাঠকদের। ক্লান্ত ও প্রেমপিয়াসী পথিককে দু’হাতে প্রেম বিলিয়ে  অনন্যা হয়ে উঠেছে যে ‘বনলতা সেন’ কবি তাকে উপস্থাপন করেছেন দারুচিনি দ্বীপের ভিতর হঠাৎ দেখা সবুজ ঘাসের দেশের উপমায়। কবি তার চোখের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজেছেন পাখির নীড়ের। সন্ধ্যার সঙ্গে মিতালী পাতিয়ে দিয়েছেন শিশিরের শব্দের । চিলের ডানায় ছড়িয়েছেন রৌদ্রের গন্ধ। সন্ধ্যার আবছা আলোয় জ্বলে উঠতে দিয়েছেন জোনাকির ঝিলমিল করা আলো। ঘরে ফিরিয়ে  এনেছেন সব পাখিকে। এমনকি নদীগুলোকেও করে তুলেছেন ঘরঘুখো। অবশেষে জীবনের সব লেনদেন মিটিয়ে দিয়ে সমস্ত চরাচরে ছড়িয়েছেন সুপ্তির অন্ধকার। সে অন্ধকারের নিবিড় প্রশান্তির মধ্যে মুখোমুখি বসিয়েছেন প্রেম প্রার্থী ও প্রেমদাত্রীকে। প্রেমের উষ্ণ অনুভবে তখন শুধু তাদেরই জীবন পূর্ণ হয়ে উঠেনি, পরিপ্লাবিত হয়েছে দশদিক। সমগ্র কবিতাটি হয়ে উঠেছে কোমল ও মধুর অনুভবে ছায়াচ্ছন্ন এবং প্রকৃতিনিষ্ঠ প্রেমের সুরভিতে সুস্নিগ্ধ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অনুপম কবিতা ‘বনলতা সেন’। যুগ যুগান্তের পথবাসী পুরুষসত্তা এখানে খুঁজে পেয়েছে নীড়ের আশ্রয়। প্রেম ও সৌন্দর্যের অনিঃশেষ দীপ্তিতে মহীয়ান হয়ে উঠেছে শাশ্বত বনারী। প্রেম ও প্রকৃতি হয়ে উঠেছে পরস্পরের সম্পূরক। ক্লান্তির স্বেদ শান্তির ছায়া হয়ে উঠেছে মুক্তাবিন্দুর মতো জ্বলজ্বলে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!