অথবা, ‘পথ জানা নাই’ গল্পের শিল্পমূল্য বিচার কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাম্প্রতিক সাহিত্যের বয়োকনিষ্ঠ ও বর্ণোজ্জ্বল শাখাটির নাম ছোটগল্প। ছোটগল্পে জীবনের উত্তাপ থাকে, হৃদয়ের আকুলতা থাকে, পর্যবেক্ষণের গভীরতা থাকে এবং থাকে কাহিনির নিটোল বিন্যাস। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রসারিত জীবনের বিস্তৃত পরিসরকে ছোটগল্প কখনোই ছুঁতে চায় না। ঘটনার পর ঘটনার চমক সৃষ্টি থেকেও আয়তন বাড়ায় না পরিসরের। তত্ত্ব কিংবা উপদেশের ভারেও ভারাক্রান্ত করে না আপন গতিময়তাকে। জীবনের কোন নির্বাচিত অংশ কিংবা উপলব্ধির কোন প্রসার মুহূর্তকে নিয়েই গড়ে উঠে ছোটগল্পের সম্পূর্ণ অবয়ব। ছোটগল্প আকৃতিতে যেমন দীর্ঘ হয় না, প্রকৃতিতেও তেমন হয় না জটিল কিংবা দুর্বোধ্য। তাই যা আকৃতিতে সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রকৃতিতে গল্প হিসেবে অনবদ্য, সাধারণভাবে তাকেই ছোটগল্প বলা হয়ে থাকে। শামসুদ্দীন আবুল কালাম বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা ছোট গল্পকার। সমাজ সচেতন গল্পকার হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সমধিক। সমাজ জীবনের নানান ব্যাধি ও বিকারকে তিনি তাঁর গল্পের উপজীব্য বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেন। ব্যক্তির উল্লাস তাকে আনন্দিত করে, তার বেদনা অথবা বিনষ্টতাকে ব্যথাতুর করে। তবে ব্যক্তিকে কখনই তিনি সমাজবিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে দেখেননি। ব্যক্তি তাঁর অধিকাংশ গল্পেই হয়ে উঠে পরিবর্তনশীল সময় ও সমাজের প্রতিনিধি। ‘পথ জানা নাই’ গল্পটিতেও ঘটেছে তারই প্রকাশ। ব্যক্তি ও সমাজ, গ্রাম ও শহর এখানে পরস্পরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে হয়ে উঠেছে একে অপরের পরিপূরক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী।
গল্পের সার্থকতা : অন্তরে বাইরে নিঃস্ব গহুরালি নামের এক সরল কৃষকের জীবনের একটি বেদনাঘন অধ্যায়কে নাটকীয় চমক আর হৃদয়ছোঁয়া আবেগের সাহায্যে গল্পটিতে মেলে ধরা হয়েছে। গল্পের ভাষা সরল ও গতিময়। বর্ণনাভঙ্গি আকর্ষণীয়, দক্ষিণ বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় গড়ে উঠা সংলাপ অঞ্চলভিত্তিক জীবনের বাস্তবতাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছে। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর কাহিনির অংশ পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। ঘটনা সংস্থাপনের ক্ষেত্রেও লেখক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পরিবেশ বর্ণনাতেও তিনি রেখেছেন পারদর্শিতার পরিচয়। ইতিহাস ও সময় সম্পর্কিত সচেতনতার যে পরিচয় লেখক দিয়েছেন সেটিও অনবদ্য। গল্পের প্রয়োজনে তিনি বেশ ক’টি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্ট চরিত্রসমূহের মধ্যে গহুরালি তার হৃদয়বেদনা নিয়ে হয়ে উঠেছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তার হৃদয়ের রক্তাক্ত ক্ষত উন্মোচনে লেখক সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছেন। আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ক্ষতিকারক পরিচয়কে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে লেখক কোথাও দ্বিধা করেন নি। গল্পটিতে গ্রামীণ নিসর্গের স্নিগ্ধ ছোঁয়া আছে। নাগরিক সভ্যতার ক্লেদাক্ত পরিচয় আছে। জীবনের উত্তাপ ও আকাঙ্ক্ষা এবং সেই সাথে আছে আকাঙ্ক্ষার অচরিতার্থতায় জমাট বাঁধা বেদনার দীর্ঘশ্বাস। স্বল্পসন্তুষ্ট জীবনের স্নিগ্ধ প্রশান্তি কিভাবে লোভের আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় গল্পটিতে রয়েছে তারই মর্মদাহী বর্ণনা। আর এই বর্ণনাকে বিশ্বাস্য ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য যে সংলাপ চরিত্র ও কাহিনি লেখক নির্মাণ করেছেন তা গল্পটিকে দিয়েছে শিল্পসফল হিসেবে গড়ে ওঠার সমূহ সুযোগ।
সীমাবদ্ধতা : জীবনকে নিয়ে গড়ে উঠে গল্প। জীবন যেমন, গল্পকার তাকে তেমনটিই দেখাবেন বলে প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু তা না করে গল্পকার যেমন তাঁর গল্পে উপস্থাপিত জীবনকে কোন উদ্দেশ্যের কাছে ক্রীড়নক অথবা বক্তব্য প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন তখন তার শিল্পমূল্য ক্ষুণ্ন হয়। ‘পথ জানা নাই’ গল্পে গল্পকার গ্রামাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কোনই আলোকিত পথের সন্ধান দিতে পারেননি। পক্ষান্তরে নাগরিক সভ্যতাকে তিনি ভয়ংকর ক্ষতিকারক হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা শুধুই অন্ধকারে আচ্ছন্ন, সেখানে কোনই আলো নেই কিংবা তার কোন ভালো দিক নেই- লেখকের এই ভাবনা অত্যন্ত একদেশদর্শী। লেখকের চিন্তা ও অনুভূতির এই একতরফা বিচার বা পক্ষপাতিত্ব তার চিন্তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগায়। আর এই প্রশ্ন গল্পের বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা ও শিল্পমূল্যকে খানিকটা ক্ষুণ্ন করে ফেলে। নির্মোহ দৃষ্টির বদলে সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে জীবনকে বিচার করতে গিয়ে লেখক তার শিল্পীসত্তাকে সংকুচিত করে প্রচারক সত্তাকে প্রসারিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তাই সচেতন পাঠক সমালোচকের কাছে গল্পটি নিটোল কিংবা নিখুঁত বলে মনে হয় না। তাছাড়া যে পটভূমিতে গল্পটি বেড়ে উঠেছে, তার পরিসর এত বিস্তৃত যে গল্পের চেয়ে উপন্যাসের জন্যই তা অধিকতর মানানসই।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিল্পের সকল শর্ত পূরণ করে ‘পথ জানা নাই’ একটি অসাধারণ ছোটগল্প হয়ে উঠতে পারেনি। তবে এক বিশেষ সময়ের ক্রান্তিলগ্নে পরিবর্তনশীল গ্রামীণ জীবনের এবং মাটিঘেঁষা মানুষের যে পরিচয় এতে মূর্ত হয়ে উঠেছে, স্বাদে ও স্বাতন্ত্র্যে তা আলাদা এবং অতীব আকর্ষণীয়।
Leave a Reply