Answer

চৈতী হাওয়া’ কবিতায় প্রকৃতি চেতনার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) চৈতী হাওয়া’ কবিতা প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার অবিনাশী দলিল। কবির বিদ্রোহী সত্তার অন্তরালে একটা প্রেমঘন মন ছিল। চৈত্রের রৌদ্রদগ্ধ প্রকৃতির মতোই কবির বিরহী সত্তার মর্মমূলে বাজতে থাকা নির্মম হাহাকার প্রকৃতি ও প্রেম চেতনার আবহে এ কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তার প্রকৃতি চেতনা মূলত প্রেমের কবিতাগুলোকে আশ্রয় করে পল্লবিত হয়েছে।
মানুষ প্রকৃতির সন্তান : ঋতুচক্রের আবহে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। এ রূপবদলের কারণেই মানব মনে তা প্রভাব ফেলে সুগভীরভাবে। প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য মানবচিত্তকে উত্তাল করে দেয়। বর্ষার অবিরাম বর্ষণ, বসন্তের মাদকতা, ঝিমমারা দুপুরের স্থবিরতা, চৈতী হাওয়ার উদাস করা মাদকতায় মানুষকে করে ভাবাকুল। সুশোভিত বৃক্ষরাজি, নিঃসীম ঝরনাধারা, নদীর কুলকুল ধ্বনি, ফুলের সৌন্দর্য আর সুবাস, পাখির অশ্রান্ত ডাক, আকাশের উদারতা, বাতাসের চপলতা যুগে যুগে মানবমনে ভাবের সৃষ্টি করেছে। প্রেম, বিরহ ও আসঙ্গলিপ্সা মানব-মানবীর হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে প্রকৃতিই ।
প্রেম ও প্রকৃতির অচ্ছেদ্যতা: নজরুল ইসলাম তাঁর চৈতী হাওয়া’ কবিতায় প্রেম ও বিরহ নিয়ে যে শব্দচিত্র অঙ্কন করেছেন তার পটভূমিতে রয়েছে বাংলার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অনুষঙ্গ। কবির সাথে তাঁর দয়িতার প্রথম মিলনের ক্ষণটি ছিল চৈতী প্রকৃতির উদাস করা মুহূর্ত। সেদিন শাখায় শাখায় ফুটেছিল নানা ফুল। দখিনা বাতাস ছুটিয়েছিল ফুলের মাদকতা ভরা গন্ধ। নেশার ঘোর লাগা উদাস দুপুরে বৃক্ষশাখায় সেদিন ডাকত ‘বউ কথা কও’ পাখি। প্রকৃতির কোলে প্রেমখেলায় মত্ত কবি যখন তাঁর প্রেয়সীর খোঁপায় চাঁপা ফুল গুঁজে দিতেন তখন বৃক্ষশাখায় পাখিটিও বোধ করি আবেগ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল-


‘খোঁপায় দিতাম চাপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ-
হিজল শাখায় ডাকত পাখি ‘বউ গো কথা কও।”


প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রেমিক যুগল : বিচিত্র প্রকৃতির বুকে কবি ও তাঁর প্রেমিকা মেতে থাকতেন সুপ্তিহীন প্রেমের লীলায়। তাদের প্রেমাবেগ ও প্রেম নিবেদনের সকল কিছু নেয়া হয়েছিল প্রকৃতি থেকে। বাতাসের ফুলের গন্ধ প্রেমিক যুগলকে পাগল করতো। পলাশ ফুলের মউ পানে তারা উন্মাতাল হয়ে পড়তেন। কাজল কালো পুকুরে প্রেমিকার রাঙা পা নামিলে দিলে গোটা পুকুরই শিহরিত হয়ে উঠত-


“হঠাৎ জলে রাখতে পা,
কাজলা দীঘির শিউরে গা-


কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল ঝিল।” এমন করে প্রেমলীলায় কীভাবে সময় অতিবাহিত হতো প্রেমিক যুগল তা জানতেন না। প্রেমে মত্ত হয়ে কবি তাঁর প্রিয়ার মাথায় চাঁপা ফুল গুঁজে দিতেন। গভীর ভালোবাসায় চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতেন প্রেমিকার ওষ্ঠাধর। প্রেমলীলার এ দৃশ্য অবলোকনে বৃক্ষশাখাও ও পুলকিত হয়ে উঠত


‘খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখী ‘বউ গো কথা কও।


চিত্রকল্পের অপূর্ব ব্যবহার : চৈতী হাওয়া’ কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতির রঙ্গরস গন্ধ সুধাপানই করেননি, প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন নিখুঁত চিত্রকল্পের মাধ্যমে। এসব চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি মর্ত্য থেকে অমর্ত্যলোকের এক আবহ সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতির অনবদ্য চিত্রময়তা প্রকাশ পেয়েছে নিম্নের উদ্ধৃতিতে-


কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল ঝিল।
ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল


প্রকৃতির মাঝে প্রিয়াকে খুঁজে ফেরা : প্রকৃতির মাঝে কবি যখন তাঁর প্রিয়াকে খুঁজে পেয়েছিলেন, তখন থেকে কবির জীবন রঙিন হয়ে উঠেছিল। প্রকৃতির মাঝে তাঁর লীলাসঙ্গিনীকে নিয়ে অবগাহন করেছেন। কোন এক মুহূর্তে তাঁর প্রিয়া হারিয়ে গেল অজানায়। কবি তাঁর প্রিয়াকে ভুলতে পারছেন না। অনির্দেশ্য গন্তব্যে প্রিয়ার হারিয়ে যাওয়ার পর তাকে আর পাননি তিনি


‘হারিয়ে গেছ অন্ধকারে পাননি খুঁজে আর
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার।


প্রকৃতির মাঝে রোমান্টিকতার বার্তাবরণ : কবি চৈতী হাওয়া’ কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতিকে ঘিরে রামান্টিকতার বাতাবরণে অবগাহন করেছেন। কবি রোমান্সের বাস্তবতা ও অবাস্তবতার দোলাচলে এক স্বপ্নময় জীবন লালন করেছেন। এতে প্রকৃতি ও প্রেম একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃতিই কবিকে নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ করেছে। কবি এ প্রসঙ্গে বলেছেন-


‘সাঁজ পড়েছে ঐ দ্বিতীয়ার চাঁদ ইহুদী দুল!
হায় গো, আমার ভীন্ গাঁয়ে আজ পথ হয়েছে ভুল।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, চৈতী হাওয়া’ কাজী নজরুল ইসলাম রচিত অন্যতম সার্থক প্রেমের কবিতা। কবি রোমান্টিকতার আবহে প্রকৃতি ও প্রেমের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। কবি এ কবিতায় প্রকৃতিকে ভাবকল্পনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যথার্থই কবি তাঁর বিরহ কাতর হৃদয়কে প্রকৃতির মাঝে অবগাহন করিয়েছেন।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!