Answer

চাকমা উপজাতির আর্থসামাজিক অবস্থা বর্ণনা কর?

অথবা, চাকমাদের আর্থ সামাজিক জীবন সম্পর্কে লিখ।
অথবা, চাকমাদের জীবন প্রণালি বর্ণনা কর।
অথবা, চাকমা উপজাতি সম্পর্কে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পৃথিবীর মানব একটি সম্প্রদায়। এই মানুষই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বসবাস করে। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানান নামে পরিচিত হয়। একই দেশে বসবাসরত কিছু মানুষকে তাদের আচরণ ভেদে অন্যান্য মানুষ থেকে আলাদা করা হয় এবং তাদেরকে উপজাতি বলা হয়। এখন আমাদের প্রশ্ন তাহলে কারা সেই উপজাতি।
চাকমা উপজাতির আর্থ-সামাজিক অবস্থা : বাংলাদেশে প্রায় ২০টি ছোট বড় উপজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাস করে পার্বত্য চট্টগ্রামে মগ, চাকমা, মুরং, মুসাই, ত্রিপুরা এবং আরো কিছু উপজাতিরা বাস করে পার্বত্য চট্টগ্রামে, খাসিয়ারা বাস করে সিলেট সীমান্তে জৈয়ান্তিয়া পাহাড়ে, মণিপুরীরা বাস করে সিলেট শহরের কাছে।
গারো, হাজং, সাঁওতাল ও দূলাই উপজাতিরা বাস করে ময়মনসিংহ জেলায় গারো পাহাড়ের সংলগ্ন এলাকায়। দিনাজপুর ও বগুড়াতে রাজবংশী ও ওরাও উপজাতি বাস করে। আমাদের আলোচ্য উপজাতি চাকমা যারা বসবাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে, এই উজাতিরা ভারতীয় আর্যদের বংশধর। এরা অন্যান্য উপজাতিদের তুলনায় উন্নত এবং সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি এবং এরা অসংখ্য গোষ্ঠীতে বিভক্ত।
১. উৎপত্তি : চাকমাদের উৎপত্তি এবং আগমন সম্পর্কে নানা মতবাদ রয়েছে। এজন্য এদের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা কষ্টকর হলেও, অনুসন্ধানের অপেক্ষা রাখে না। নৃতত্ত্ববিদ হার্বাট রিজলের মতে, “ব্রাহ্ম থাক বা সেক জাতি থেকে চাকমাদের উৎপত্তি। চাকমারা মনে করে তারা এককালে চম্পক নগরের বাসিন্দা ছিল। আর সেই চম্পক নগরের নাম অনুসারে তাদের নাম হয়েছে চাকমা।
২. নামকরণ : চাকমা সমাজের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী চাঙমা নামেই নিজেদের পরিচয় দেন। আধুনিক শিক্ষিত যুবক চাকমাদের অনেকেই চাকমার চেয়ে চাঙমা নামটি ব্যবহারের পক্ষপাতি। কিন্তু বয়স্ক শিক্ষিত চাকমাগণ নিজেদের জন্য চাকমা নামটি ব্যবহার করেন।
৩. বাসস্থান : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এরা বাস করে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এই অঞ্চলে এরা বসবাস করে। তবে রাঙ্গামাটিতে বেশি চাকমা বাস করে। এর পরই খাগড়াছড়ি, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও বেশ কিছু চাকমা বাস করে।
৪. নরগোষ্ঠীর পরিচয় : চাকমাদের মধ্যে লক্ষণীয় নরগোষ্ঠীর প্রভাব বাঙালিদের তুলনায় অনেক বেশি এবং লম্বা জাতির। এদের রং ফর্সা। এরা বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। এরা দৈহিক দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী।
৫. ভাষা : চাকমাদের ভাষা অন্যান্য উপজাতি থেকে আলাদা। এদের ভাষার নাম চাকমা বা চাওমা ভাষা। তবে চাকমা ভাষাও বাংলা শব্দের ৮০% ছড়িয়ে গিয়েছে এবং সেই সঙ্গে চাকমা ভাষাকে বাংলা উপজাতি ভাষা বলা যেতে পারে । চাকমাদের লিপি আছে, এতে বর্মী অক্ষরের লেখার প্রাধান্যই বেশি। সব চাকমাই লেখার জন্য বাংলা ভাষা ব্যবহার
করে। সম্প্রতি সুগত চাকমা ‘চাকমা বাংলা অভিধান’ নামে একটি অভিধান রচনা করেছেন। ঐ অভিধানে চাকমা ও বাংলা শব্দ পাশাপাশি লেখা হয়েছে।
৬. জনসংখ্যা : জনসংখ্যার দিক দিয়ে চাকমারা বাংলাদেশের অন্যান্য উপজাতি হতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশে চাকমারা মোট উপজাতির অর্ধেক। ১৯৭০ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বাড়তেই থাকে। ১৯৮১ সালের গণনা অনুযায়ী চাকমারা প্রায়২,১২,৫৭৭।
৭. ধর্ম : চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে। এজন্য চাকমা গ্রাম এলাকায় মাঝে মাঝে বৌদ্ধ মন্দির দেখা যায়। চাকমারা বৌদ্ধ হলেও তাদের মাঝে দু’ধরনের পূজা লক্ষ করা যায়। গঙ্গা দেবীর পূজা এবং লক্ষ্মী দেবীর পূজা যা হিন্দুর সাথে মিলে যায়।
৮. পরিবার : চাকমা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ চাকমা পরিবারের ক্ষমতা স্বামীর হাতে অথবা বয়স্ক পুরুষের হাতে ন্যস্ত । চাকমা সম্পত্তি, বংশ পরিচয় পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়।
৯. বিবাহ : চাকমাদের মধ্যে পিতৃবংশ সাত পুরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। কার্যত চাকমারা এই রীতি মেনে চলে না। চাকমা সমাজে ক্রস কাজিন বিবাহ প্রচলিত আছে। অর্থাৎ মামাতো, ফুফাতো ভাই বোনের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত।
১০. অর্থনীতি : চাকমারা জুম চাষের উপর বেশি নির্ভরশীল। লাঙ্গল গরু ছাড়াই এই জুম চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রধান উপাদান, দু’পাহাড়ের সমতল অংশে চাকমারা ধান চাষ করে থাকে। তারা রাবার ও কাঠের গাছের চাষ করে থাকে।
১১. শিক্ষা : চাকমারা অন্যান্য উপজাতির তুলনায় অধিক শিক্ষিত, তারা বাংলা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তির ক্ষেত্রে তারা কোটা পাচ্ছে। তারা অন্যান্য সভ্যসমাজের মানুষের মত জীবনযাপন শুরু করেছে।
১২. সমাজ : চাকমা সমাজের প্রথম এবং ক্ষুদ্র সংগঠন হচ্ছে পরিবার। তারপর রয়েছে গোত্র বা গোঁজা। এরপর রয়েছে আদিম পাড়া। এরপর গ্রাম বা মৌজা। পরে বৃহত্তম চাকমা সমাজ বা চাকমা সার্কেল।
১৩. বিবাহ বিচ্ছেদ : চাকমা সমাজে সাধারণত বিবাহ বিচ্ছেদ দেখা যায় না। বিবাহ বিচ্ছেদ জরুরি হলে গ্রাম শালিস বসে। স্বামী দোষী হলে তাকে জরিমানা করা হয়। আর স্ত্রী দোষী হলে স্বামীর দেওয়া জিনিসপত্র ফেরত দিতে হয়।
১৪. নেতৃত্ব : চাকমা সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে রাজা ব্যবস্থা এখনো প্রচলিত। এই নেতৃত্ব ব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিবর্তন এসেছে।
১৫. আদিম পাড়া : কতকগুলো চাকমা পরিবার নিয়ে গঠিত হয় আদিম পাড়া। আদিমের প্রধানকে বলা হয় কারবারী। চাকমা রাজা তাকে নিয়োগ করেন।
১৬. গ্রাম বা মৌজা : কতকগুলো চাকমা আদাম মিলে গঠিত হয় গ্রাম বা মৌজা। মৌজার প্রধানকে বলা হয় হেডম্যান। চাকমা রাজার সুপারিশে ডেপুটি কমিশনার তাঁকে নিয়োগ দান করেন। তিনি শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও খাজনা আদায় করেন।
১৭. সার্কেল : চাকমা সমাজের কয়েকশত মৌজা মিলে চাকমা সার্কেল গঠিত। সার্কেলের প্রধানকে রাজা বলা হয়। চাকমা রাজা বংশপরম্পরায় চলে। বিচার ব্যবস্থা সহ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করেন।
১৮. স্থানীয় জেলা সরকার পরিষদ : ১৯৮৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় আঞ্চলিক নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে স্থানীয় জেলা সরকার পরিষদ গঠিত হয়। এর ফলে চাকমারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পায় ।
১৯. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া : চাকমা সমাজে মৃতদেহ পোড়ানো হয়। সাত বছরের কম বয়সীদের কবর দেওয়া হয়। মৃত্যুর সাত দিন পর ‘সাত দিন্যা’ নামে অনুষ্ঠান করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে চাকমা সমাজে এসেছে নানাবিধ পরিবর্তন। সরকারের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে চাকমাদের জীবনযাপন ও আর্থ- সামাজিক অবস্থার নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে তারা শিক্ষা চালচলনে বাঙালিদের মতই। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অদূর ভবিষ্যতে চাকমারা সভ্য সমাজের বাসিন্দা হবে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!