চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেইজিং প্লাটফর্ম ফর এ্যাকশন কর্তৃক চিহ্নিত ১২টি বিবেচ্যবিষয় কী কী? এ সম্পর্কে বিভিন্ন পদ্ধতি আলোচনা কর।
অথবা, চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনে বেইজিং প্লাটফর্ম ফর এ্যাকশন মূল্যায়ন কর।
অথবা, চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনে চিহ্নিত বিবেচ্য বিষয় আলোচনা কর।
অথবা, চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনে চিহ্নিত বিবেচ্য বিষয় বর্ণনা কর।
অথবা, চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের চিহ্নিত ১২টি বিবেচ্য বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তরয় ভূমিকা : বিশ্ব নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী উন্নয়ন ক্ষেত্রে যেসব বাস্তবমুখী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে Beijing নারী সম্মেলন তাদের মধ্যে অন্যতম। এ সম্মেলন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেছে। এ সম্মেলনের বড় সাফলা হচ্ছে নারীর অধস্তন অবস্থা চিহ্নিত করে একটি খসড়া দলিল তৈরি করা, যা ‘Beijing Platform for Action’ নামে পরিচিত। বেইজিং প্লাটফর্ম ফর একশন হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নের Agenda এবং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের মূল দলিল। এটিকে বিশ্ব নারীসমাজের অগ্রগতির জন্য একটি নীলনকশা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মূলত জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাধারণ পরিষদের প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এ কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।
চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন কখন এবং কোথায় অনুষ্ঠিত হয় : চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন ১৯৯৫ সালের ৪ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর চীনের রাজধানী বেইজিংএ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৮৫টি দেশের ৩০ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। বেইজিং সম্মেলনে পেশ করার উদ্দেশ্যে কমিশনের ৩৯তম অধিবেশনে ২৪৬ নং অনুচ্ছেদে Platform for Action দলিলটি অনুমোদন করা হয়। বিশ্ব নারীসমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আশা- আকাঙ্ক্ষার মধ্যদিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয় এ সম্মেলন।
চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে চিহ্নিত বিবেচ্য বিষয় : নিম্নে Platform for Action কর্তৃক চিহ্নিত ১২টি বিবেচ্য বিষয় এবং এ সম্পর্কে করণীয় বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. নারী ও দারিদ্র্য : বিশ্বের ১২ বিলিয়ন দারিদ্র্যের প্রায় ৬০ শতাংশ নারী। অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা ও স্বশাসন, জমির মালিকানা ও উত্তরাধিকার, শিক্ষা ও সহায়ক সার্ভিসের অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ না থাকায় নারীসমাজের কাঁধে দারিদ্র্যের বাড়তি বোঝা চেপে বসেছে। এ দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
২. নারী ও শিক্ষা : শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে অসমতা, অপ্রতুলতা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষা থেকে নারীরা বঞ্চিত। বিশ্বের ১ বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক নিরক্ষরের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই নারী এবং এদের অধিকাংশই গ্রামের বয়স্ক মহিলা শিক্ষা উন্নয়নের জন্য সরকারি, দাতাগোষ্ঠী, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কতিপয় করণীয় সুপারিশ করা হয়েছে।
৩. নারী ও স্বাস্থ্য : জৈবিক পার্থক্য ও সামাজিক অবস্থা, বৈষম্য ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিচর্যার অভাব, খাদ্যাভাব ও বিশুদ্ধ পানির অপর্যাপ্ততা এবং অন্যান্য সুযোগের অভাবে গ্রামীণ মহিলার স্বাস্থ্যহানির কারণ। স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সরকার, জাতিসংঘ, চিকিৎসা সম্প্রদায়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, N.G.O, মিডিয়া ও অন্যান্যের সহযোগিতায় নিম্নের কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে-
i. নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীন স্বাস্থ্য কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
ii. সাধ্যের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা।
iii. মেয়েদের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টিদান।
iv. HIV, AIDS ও যৌন সংসর্গের মাধ্যমে সঞ্চালিত রোগের জন্য সাধ্যের মধ্যে প্রতিষেধক প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
v. নারী স্বাস্থ্যের উপর গবেষণা জোরদার করা।
৪. নারীনির্যাতন: নারীনির্যাতন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। পুরুষরা মেয়েদের উপর আধিপত্য বিস্তার ও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। মেয়েদের আইনগত তথ্য, সাহায্য বা নিরাপত্তা লাভের সুযোগের অভাব, অভাব এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিরাজমান আইন বলবৎ করতে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের অভাব নারীনির্যাতন বৃদ্ধির কারণ।
৫. নারীর প্রতি সহিংসতা ও সশস্ত্র সংঘাত : যুদ্ধ বা অন্যান্য সশস্ত্র সংঘাতের সময় নারীসমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। মেয়েরা যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে নির্যাতন, শ্রম ও পরিকল্পিত ধর্ষণের শিকার। BPFA প্রস্তাবিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে,
ক. সরকারের করণীয় :
i.সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং তহবিল গঠনের উদ্দেশ্য সামরিক ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে বিনিয়োগ সম্পদ সৃষ্টির নতুন নতুন উপায় গ্রহণ করা।
ii. সশস্ত্র সংঘাতে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন করা।
খ. আন্তর্জাতিক সংস্থা ও NGO গুলোর করণীয় :
i.শরণার্থী মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী : খাদ্যের প্রাথমিক যোগানদাতা নারীসমাজ হলেও কিংবা সর্বত্র অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তাদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে রাখা হয়। আর এটাই তাদের অর্থনৈতিক অধস্তনতার মূল কারণ ।
ক. সরকারের করণীয় :
i. নারী ও পুরুষের সমান কাজের জন্য সমান মজুরির অধিকার নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন ও বলবৎ করা।
ii. অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মেয়েদের অংশগ্রহণ করার জন্য পদ্ধতি উদ্ভাবন ও গঠনমূলক কর্মব্যবস্থা প্রয়োগ করা।
খ. সরকার ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের করণীয় :
i.উপদেষ্টা বোর্ড ও অন্যান্য ফোকাসে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
ii. মেয়েদের ঋণদান বাড়াতে ব্যাংকিং খাতকে উৎসাহিত করা।
৭. সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নারী : সমাজকে রূপদানকারী ক্ষমতার কাঠামোতে এখনও নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। প্রচলিত প্রথা ও নিয়মনীতির কারণে মেয়েরা সমাজের উচ্চ পদগুলোতে এখনও অংশগ্রহণ করতে পারছে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সমতা উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না।
৮. মানবাধিকার : আইনের দ্বারা নারীসমাজের অধিকার নিশ্চিত করা থাকলেও সাধারণত সেগুলো পুরোপুরি আদায় করতে তারা অক্ষম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপযুক্ত বাস্তবায়ন ব্যবস্থারও অভাব রয়েছে। ফলে নারীর মানবাধিকারের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাবোধের অভাব অপ্রতুল, প্রসার ও সংরক্ষণ পরিলক্ষিত হয় । BPFA প্রস্তাবিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে-
i. নারীসমাজের বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত কনভেনসনসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিসমূহ অনুমোদন বা মেনে চলা।
৯. প্রাতিষ্ঠানিক কার্যসাধন পদ্ধতি : অধিকাংশ দেশে নারীসমাজের অগ্রগতির লক্ষ্যে জাতীয় প্রতিষ্ঠান যেমন- মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান অফিস, গবেষণা, ইনস্টিটিউট ইত্যাদি গঠন করা হলেও পর্যাপ্ত কাজ করার ক্ষেত্রে সেগুলোর অর্থ ও মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অনুরূপ সমস্যা রয়েছে। ফলে নারী পুরুষ বৈষম্য সম্পর্কিত তথ্য ও পরিসংখ্যানও অপর্যাপ্ত । BPFA প্রস্তাবিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে,
i. সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারীসমাজের অগ্রগতির জন্য জাতীয় কার্যপদ্ধতি গড়ে তোলা।
ii. নারীসমাজ সম্পর্কিত ডাটা সংগ্রহ, মজুত, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করা।
১০. গণমাধ্যমে নারী : সব গণযোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে প্রচার ব্যবস্থায় নারী বিষয়ে ছক বাঁধা উপস্থাপন এবং প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীকে খুব বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়, যা তার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে। সাধারণত পুরুষের দ্বারা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এ কারণে গণমাধ্যমে তাদের (পুরুষের) ধ্যানধারণা ও অগ্রাধিকারের প্রতিফলন থাকা স্বাভাবিক। BPFA প্রস্তাবিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে,
i. গণমাধ্যমে মেয়েদের সমান অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা।
ii. মেয়েদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি উন্নয়নকে উৎসাহিত করা।
iii. তথ্য প্রযুক্তির বৃহত্তর ব্যবহারের জন্য মেয়েদের প্রশিক্ষণ দান।
১১. পরিবেশ উন্নয়নে নারী : অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে জ্বালানি ও পানি সংগ্রহ এবং খাদ্যদ্রব্য তৈরির কাজ মেয়েরাই করে থাকে। কিন্তু সিদ্ধান্তগ্রহণ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় নারী পুরুষ বৈষম্য করা হয়। BPFA প্রস্তাবিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে,
i. সর্বস্তরে পরিবেশগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা।
ii. নারী বিষয়ক উপাত্ত গড়ে তোলা এবং নারী ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের উপর গবেষণায় সহায়তা করা।
১২. কন্যা শিশু : শৈশব থেকেই কন্যা শিশুর বিরুদ্ধে বৈষম্য শুরু হয় এবং অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সচরাচর মেয়েদের অধস্তন হিসেবে গণ্য করা হয়। সামাজিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা ও তাতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কম উৎসাহিত করা হয়। ফলে সামাজিক ব্যাপারে ছেলেদের মত মেয়েরা সমানভাবে জড়িত হওয়ার
সুযোগ পায় না । PFA প্রস্তাবিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে,
i.মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষালাভ নিশ্চিত করা
ii. বিয়ের ন্যূনতম বয়স সম্পর্কে আইন পাস এবং তা কঠোরভাবে বলবৎ করা।
iii. মেয়েদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ পরিবর্তনকরণে উৎসাহিত করা।
iv. অর্থনৈতিক শোষণ থেকে কন্যাশিশুকে রক্ষা করা এবং কাজে প্রবেশের ন্যূনতম বয়স বেঁধে দেওয়া।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বেইজিং সম্মেলনে বিশ্ব নারী উন্নয়নের সকল দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার অনুসারী নারীসমাজ তাদের মৌলিক প্রশ্নে সম্মতি প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী নারীসমাজের বিরুদ্ধে নির্যাতন, উৎপীড়ন, সহিংসতা প্রশমন করে নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের মান উন্নয়নের সফলজনক দিকনির্দেশনা এ সম্মেলনে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে।