অথবা, চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন কোথায় অনুষ্ঠিত হয়? এ সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ দাও।
অথবা, চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন কী? এ সম্মেলনের মূল দলিলসমূহ লিখ।
অথবা, চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন কী? এ সম্মেলনের কৌশলগত লক্ষসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৯৫ সালের ৪ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের প্রচেষ্টায় চীনের রাজধানী বেইজিং-এ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে গৃহীত বিশ্ব নারী সম্মেলনসমূহের মধ্যে এ সম্মেলনের গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ। এ সম্মেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য বিশ্বের ৩৫,০০০ নারী অংশগ্রহণ করে। বেইজিং- এ অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনকে ‘বেইজিং সম্মেলন’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এটি ‘প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন’ নামে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে।
বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন (Beijing Platform For Action) : বেইজিং প্ল্যাটফরম পর অ্যাকশন হচ্ছে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের মূল দলিল। বেইজিং প্ল্যাটফরম পর অ্যাকশন/পিএফএ স্পষ্ট করে দেখিয়েছে যে, নারীর অধিকার, সমতা ও উন্নয়নে বাধা আছে বহু রকমের। এর মধ্যে ১২টি বিষয়কে নারী প্রগতি ও উন্নয়ন সমতার বাধা হিসেবে বিবেচনা করে তা থেকে উত্তরণের কৌশল ওসরকারি-বেসরকারি স্তরে সংশ্লিষ্ট সকলের করণীয় নির্দিষ্ট করেছে। বিবেচনার গুরুতর ক্ষেত্রসমূহ হচ্ছে:
১. নারী ও দারিদ্র্য : বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। তার মধ্যে নারীরাও বিদ্যমান। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য ভিন্নভাবে পরিদৃষ্ট হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বে পুরুষের তুলনায় নারীর দারিদ্র্যের হার অসম হারে বৃদ্ধি পায়। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সম্পদের মালিকানার অভাব প্রভৃতি বিষয় এর জন্য দায়ী। এ থেকে উত্তরণের জন্য কৌশলগত লক্ষ্য নিম্নরূপ :
কৌশলগত লক্ষ্য : দারিদ্র্যপীড়িত নারীর চাহিদা ও প্রচেষ্টার সমর্থনে অর্থনৈতিক নীতিমালা ও উন্নয়ন কৌশলগুলোর পুনর্মূল্যায়ন, অনুমোদন এবং অনুসরণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। ঋণ এবং সঞ্চয় প্রক্রিয়ায় নারীর প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা। জেন্ডারভিত্তিক কর্মপদ্ধতির উন্নয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে দরিদ্র নারীদের সাহায্য করা।
২. নারীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : শিক্ষা একটি মানবিক অধিকার, সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি অর্জনে শিক্ষা আবশ্যকীয়। বৈষম্যহীন শিক্ষা ছেলে ও মেয়ে উভয়কে উপকৃত করে। শিক্ষা নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাল্যবিবাহ ও গর্ভধারণ, শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা, যৌন হয়রানি প্রভৃতি নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এর ফলে তারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারে না এবং এক পর্যায়ে ঝড়ে পড়ে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে যা নারীর জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করে।
কৌশলগত লক্ষ্য : শিক্ষায় সমান সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করে বৈষম্যহীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শিক্ষা সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ এবং বাস্তবায়ন মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা। মেয়ে ও নারীর জন্য আজীবন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ উন্নত করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ডিগ্রি-৬ষ্ঠ পত্র)-৬১
৩. নারী ও স্বাস্থ্য : নারী তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণ করার অধিকার রাখে। কিন্তু নানা কারণে নারী তার এ অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। এছাড়া বাল্যবিবাহ, গর্ভধারণ, যৌনাঙ্গচ্ছেদের ন্যায় বিভিন্ন বিষয় নারীর স্বাস্থ্যকে চরমভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। বয়ঃসন্ধিকালে নারীর যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা প্রয়োজন সেক্ষেত্রেও নারী বঞ্চিত হয়।
কৌশলগত লক্ষ্য : নারী স্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণের জন্য সহজবোধ্য, মানসম্পন্ন ও যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা ও তথ্য প্রচার ত্বরান্বিত করা, নারী স্বাস্থ্যের জন্য সম্পদ বৃদ্ধি করা এবং ফলোআপ মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা এবং যৌন বাহিত রোগ সম্পর্কে তাদের সজাগ করে তোলা।
৪. নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা : বিশ্বব্যাপী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রেই নারী বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, পাচার, পতিতাবৃত্তি, খুন, গর্ভপাত প্রভৃতি বিভিন্ন রকম সহিংসতার উদাহরণ। নারীর বিরুদ্ধে যে সহিংসতা ঘটানো হয় তার জন্য
দায়ী কারণগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত গবেষণা হয় না ফলে এটি রোধ করার জন্য কৌশল গ্রহণও সম্ভব হয় না।
কৌশলগত লক্ষ্য : নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার কারণ, এটি প্রতিরোধের উপায়, নারী পাচার বন্ধ, বেশ্যাবৃত্তি ও পাচারের কারণে সৃষ্ট সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা।
৫. নারী ও সশস্ত্র সংঘাত : সশস্ত্র সংঘাত বিশ্বশান্তি ক্ষুণ্ণ করে, এরূপ পরিস্থিতিতে নারী, শিশু, বয়স্ক ও বিকলাঙ্গরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের ফলে গণহত্যা, ধর্ষণ ও শরণার্থী জনগণ প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। এ সকল বিষয় নারীকে নাজুক করে তোলে।
কৌশলগত লক্ষ্য : সংঘাতময়, পরিস্থিতিতে নারীর নিরাপত্তা বিধান করা, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রত্যাশী শরণার্থী ও অন্যান্য উদ্বাস্তু নারী এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত নারীর জন্য নিরাপত্তা, সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৬. নারী ও অর্থনীতি : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী বৈষম্যের শিকার হয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণে বিভিন্ন পর্যায়ে নারী প্রায় অনুপস্থিত থাকে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, নিয়োগ, পদোন্নতি, বেতন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের স্বীকার হয়।
কৌশলগত লক্ষ্য : কর্মক্ষেত্রে কাজের উপযুক্ত পরিবেশ, সম্পদের লাভের অধিকার, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সহজতর করা, পেশাগত ও চাকরির ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য রোধ করা ইত্যাদি নানা রকম আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করা ও তা প্রয়োগ করা।
৭. ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী : একটি দেশের সরকার গঠনে প্রত্যেক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। নারী ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। রাজনৈতিক দল, মালিক সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন, স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সর্বত্র নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের হার সীমিত। কাঠামোগত ও নারীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য দায়ী।
কৌশলগত লক্ষ্য : ক্ষমতা কাঠামো ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর সমান সুযোগ ও পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
৮. নারীর অগ্রগতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কার্যপদ্ধতি : জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত সকল সদস্য দেশ নারীর অগ্রগতির জন্য জাতীয় বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করলেও এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রেই সমস্যা বিরাজমান।
কৌশলগত লক্ষ্য : জাতীয় বিধিব্যবস্থা এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠা/শক্তিশালী করা, আইন প্রণয়ন, সরকারি নীতি ও কর্মসূচি জোরদার করা, পরিকল্পনা ও মূল্যায়নের জন্য জেন্ডার ভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রচার করা।
৯. নারীর মানবাধিকার : মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও মান্য করা ও সংরক্ষণের কথা বলে। কিন্তু ভাষা-ধর্ম-বর্ণ-জাতীয় সত্তা প্রভৃতি বিষয় নারীর মানবাধিকারের পথ রুদ্ধ করে।
কৌশলগত লক্ষ্য : নারীর বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য বিলোপ করে কনভেনশনের পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার উন্নত ও রক্ষা করার ব্যবস্থা করা।
১০. নারী ও প্রচারমাধ্যম : প্রচারমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ সক্রিয় হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী-অনেকটা পিছিয়ে, স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল প্রচারমাধ্যম জেন্ডার সংবেদনশীল হতে বহুলাংশে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
কৌশলগত লক্ষ্য : প্রচারমাধ্যমে নারীর ভারসাম্যপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময় চিত্রায়ন উন্নয়ন করা হয় এবং মতামত প্রকাশেরসুযোগ প্রদান করা।
১১. নারী ও পরিবেশ : “বিভিন্ন রকম পরিবেশগত প্রতিকূলতা যেমন- বৈশ্বিক উষ্ণতা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, যুদ্ধ ও সহিংসতার ন্যায় কতকগুলো পরিবেশগত বিপর্যয় নারীর স্বাস্থ্য ও জীবনমানের ক্ষতি করে।
কৌশলগত লক্ষ্য : পরিবেশগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে সম্পৃক্ত করা, টেকসই উন্নয়নের নীতি ও কর্মসূচিতে জেন্ডার প্রেক্ষাপট সম্পৃক্ত করা।
১২. মেয়ে শিশু : বিশ্বের বহু দেশে মেয়ে শিশু জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, শ্রমভিত্তিক অর্থনৈতিক শোষণ, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে মেয়ে শিশুরা বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হয়। এছাড়া, ধর্ষণ, নিপীড়ন, পাচার, যৌন নিপীড়ন, শোষণ ইত্যাদি নানা
অমানবিক ঘটনারও শিক্ষার হয় মেয়ে শিশুরা।
কৌশলগত লক্ষ্য : মেয়ে শিশুদের বিরুদ্ধে সর্ব ধরনের বৈষম্য বিলোপ করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও পরিবেশ নিশ্চিত করা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বেইজিং সম্মেলনে বিশ্ব নারী উন্নয়নের সকল দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। এই সম্মেলনে নারীসমাজের উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবিত কৌশলগত লক্ষ্যসমূহ যেমন নির্ধারিত হয়েছে তেমনি বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও কার্যক্রমও গৃহীত হয়েছে। এ কর্মপরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী নারীসমাজকে নবযুগের সন্ধান দিবে বলে আশা করা যায়।
চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন সম্পর্কে আলোচনা কর।
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079
Leave a Reply