গ্রামীণ কোন্দল কী? বাংলাদেশের গ্রামীণ কোন্দলের কারণ আলোচনা কর।

অথবা, গ্রামীণ কোন্দল বলতে কী বুঝ? গ্রামীণ কোন্দল কেন সৃষ্টি হয়? বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ কোন্দল কাকে বলে? বাংলাদেশের গ্রামীণ কোন্দলের কারণ বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ কোন্দলের সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশের গ্রামীণ কোন্দলের কারণ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গ্রামীণ কোন্দল কী? বাংলাদেশের গ্রামীণ কোন্দল সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
গ্রামীণ কোন্দল গ্রামীণ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। সাধারণত গ্রাম্য সমাজব্যবস্থার সামাজিক প্রতিপত্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা এ কোন্দলের অন্যতম প্রধান কারণ।
গ্রামীণ কোন্দল : গ্রামীণ সমাজের অধিবাসীরা বিভিন্ন কারণে নিজেদের মধ্যে গোত্রে-গোত্রে, এক গ্রামের সাবে অন্য গ্রামের যে ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব কলহের সৃষ্টি করে তাকে এককথায় গ্রামীণ কোন্দল বলে। যদিও গ্রামীণ জীবনে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির বন্ধন বেশি। সেখানে মানুষ একে অপরের জন্য সর্বদা নিবেদিত। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশ হিসেবে প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ এখানে সুখে শান্তিতে বসবাস করার জন্য কলহ।বিবাদ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। গ্রামে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের পাশাপাশি কলহ বিবাদেরও উৎপত্তি ঘটে। গ্রাম সমাজে কোন্দলের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কোন্দল গ্রামের শাস্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে গ্রামের শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিষিয়ে তোলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : গ্রামীণ কোন্দল সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন প্রকার মতামত ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো :
নিকদাস (Nichdas) এর মতে, “কোন্দল এক ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।কোন্দল বলতে তিনি গ্রামে আধিপতা বিস্তারের এক ধরনের কৌশল বা প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।”
বেইলি (Baily) বলেছেন, “গ্রামের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড কোন্দলের সৃষ্টি করে। তিনি একে গ্রামীণ রাজনীতিতে
উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের একটি ফল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।”
মুরভক (Murdock) বলেছেন, “পারস্পরিক প্রতিযোগিতা থেকে কোন্দলের সূত্রপাত হয়। ভৌকোলিস, আঞ্চলিক,জাতিভিত্তিক গোষ্ঠীগুলো যখন নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে তখন অনিবার্য ফলস্বরূপ কোন্দলের সৃষ্টি হয়।”
বি. কে. জাহাঙ্গীর (B. K. Jahangir) বলেছেন, “গ্রামীণ কোন্দল শ্রেণি সংগ্রামের ফল। Class in itself থেকে class for itself এ রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোন্দলের সৃষ্টি হয়। তিনি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে কোন্দলের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন।”
( Areans and Buerden) দম্পতি বাংলাদেশের একটি গ্রামে কোন্দলের উপর গবেষণা করেন। তিনি দেখান যে
গ্রামের এলিট শ্রেণি সেখানে মোট আবাদযোগ্য জমির অর্ধেক দখল করে আছে। জমির ভোগ দখলকে কেন্দ্র করে সেখানে কোন্দলের উদ্ভব হয়।
জি. ডি. উড এবং হামজা আলাভি (G. D. Wood) এবং (Hamza Alavi) মনে করেছেন, গ্রামের এলিট গ্রুপ নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য কোন্দলের সৃষ্টি করে। তাঁরা গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, একই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের কোন্দলের উদ্ভব হয়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ কোন্দলের কারণ : বাংলাদেশে গ্রামীণ কোন্দল যেসব কারণে হয়ে থাকে সেগুলো নিম্নরূপ :
১. জ্ঞাতিগোষ্ঠী : গ্রামীণ কোন্দল সৃষ্টি প্রথমত জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই হয়ে থাকে। একই গ্রামে একই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকজন পাশাপাশি বসবাস করে। এরূপ পাশাপাশি বসবাসের উদ্দেশ্য হলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতি।তাছাড়া আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন করে। গ্রামে পিতৃবংশীয় ও মাতৃবংশীয় উভয় ধরনের গোষ্ঠী লক্ষ করা যায়। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে। গ্রামে একই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জমিজমা ও অন্যান্য কারণে কোন্দলের সৃষ্টি হয়। সঠিক উত্তরাধিকার নীতি অনুসরণ না করে জমিজমা বণ্টন করা হলে সুবিধা বঞ্চিত গোষ্ঠী সহজেই কোন্দলের পথ বেছে নেয়। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার এ ধরনের কোন্দল দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। এমনকি বংশপরম্পরায় এটি চলতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরবর্তী বংশধরদের কোন্দল চালিয়ে যেতে বলা হয়। জ্ঞাতি সম্পর্ক সম্প্রীতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করলেও কখনো কখনো কোন্দলের সৃষ্টি করে। এ ধরনের কোন্দল আবার মীমাংসিতও হয়ে যেতে দেখা যায়।
২. জমির মালিকানা : গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। ভূমি মালিকানার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে গ্রামীণ আভিজাত্য ও ক্ষমতা। ভূমিই তাদের প্রধান সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য। অনিবার্যভাবে তাদেরকে কৃষির জন্য ভূমির উপর নির্ভর করতে হয় । ভূমির উপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কোন্দলের সৃষ্টি হয়। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সম্মান ও প্রতিপত্তি চায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি মানুষ অন্যায় করে হলেও অপরের জমি ভোগ দখলের চেষ্টা করে। সমাজে যারা ক্ষমতাবান তারা গায়ের জোরে অন্যের জমি দখল করতে চায়। ভূমির ভোগ দখলকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব সংঘাত দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। সাধারণত যাদের জমির পরিমাণ কম তাদের ক্ষমতাও কম। এভাবে দরিদ্র কৃষকরা ধনী কৃষকদের শিকারে পরিণত হয়। ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে জীবনহানি পর্যন্ত ঘটে থাকে। মামলা মকদ্দমা করতে গিয়ে দরিদ্র কৃষকরা
নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে যায়। তাদের যে সামান্য জমিজমা থাকে সেটুকুও হারাতে হয়।
৩. ক্ষমতা কাঠামো : গ্রামীণ জনগণের প্রধান সম্পত্তি ভূমি। ভূমির পরিমাণের উপর নির্ভর করে গ্রামীণ জনগণের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি। যাদের ভূমির পরিমাণ বেশি তারা সমাজের সর্বময় ক্ষমতা লাভ করে। সমাজে তারা নেতৃত্ব প্রদান করে। গ্রামের সমগ্র জনগণ একতাবদ্ধ থাকলে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা কমে যায়। বলতে গেলে তাদের ক্ষমতা থাকে শূন্যের কাছাকাছি। গ্রামে বিভিন্ন গ্রুপ সৃষ্টি করতে পারলে ক্ষমতাবানরা সহজেই তাদের স্বার্থোদ্ধার করতে পারে। এজন্য তারা সুকৌশলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সব সময় দ্বন্দ্ব সংঘাত টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। একই গ্রামে একাধিক গ্রুপ সৃষ্টি হলে কোন্দলের সৃষ্টি হয় ।
৪. জমির সীমানা নির্ধারণ : গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমিতে সীমা নির্ধারণের জন্য আইল ব্যবহার করা হয়। আইলের মাধ্যমে গ্রামের জমিগুলো পৃথক করা হয়। আইলের আকার সাধারণত একই রকম হয়। গ্রামাঞ্চলে জমির সীমানা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। সঠিকভাবে আইল না দিয়ে অন্যের জমিতে আইল দিয়ে নিজের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য অনেকে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। আইলের জমিতে কারও মালিকানা থাকে না। কিন্তু আইলের মাধ্যমে জমির সীমানা নির্ধারিত হয় বলে এ নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের বন্যাপীড়িত অঞ্চলে আইল নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয় সবচেয়ে বেশি। বন্যায় জমির আইল একাকার হয়ে যায়। বন্যা শেষে নতুন আইল তৈরির সময় দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
৫. সামাজিক মর্যাদা ও আনুগত্য : গ্রামে ক্ষমতা ও মর্যাদার চর্চা করতে গিয়ে মানুষ হীন পন্থা অবলম্বন করে। গ্রামে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিরোধ উসকে দেয়। তারা কোনো পক্ষকে সমর্থন দানের মাধ্যমে বিরোধের গতি বৃদ্ধি করে। মানুষ মর্যাদা ও ক্ষমতালাভের মধ্যদিয়ে গ্রামের রাজনীতিতে প্রবেশ করে।
৬. উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা : গ্রামের উন্নয়নের জন্য সরকার প্রতি বছর অর্থ বরাদ্দ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে
গ্রামের উন্নয়নে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এগিয়ে আসে। এসব সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য হলো গ্রামীণ উন্নয়ন। আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় গ্রামেরই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নিকট। এসব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে স্কুল, কলেজ, রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, খাল খননের কাজ প্রভৃতি থাকে। এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে একদিকে যেমন আর্থিক সুযোগ সুবিধা লাভ করা যায়, তেমনি সমাজে মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। মানুষ এসব সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় কাজের দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে যায়। একাধিক ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে উদ্যোগী হলে স্বাভাবিকভাবেই কোন্দলের সৃষ্টি হয়।
৭. রিলিফ কটন : গ্রামীণ অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্যার্থে সরকার প্রতি বছর রিলিফ প্রেরণ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসে। গ্রামের প্রকৃত অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্যের জন্যে রিলিফ প্রদান করা হয়। কিন্তু অনেক সময় প্রকৃত অসহায়রা রিলিফ না পেয়ে অন্যান্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রিলিফ ভোগ করে, যার মাধ্যমে গ্রামে রিলিফ প্রদান করা হয় তার পক্ষপাতিত্বের জন্য এরূপ হয়ে থাকে। রিলিফ সরবরাহকারীর পছন্দের রাজনৈতিক দলের কেউ হলে সে সহজেই রিলিফ পেয়ে যায়। প্রতিপক্ষের লোকজন এসব কারণে কোন্দলের সৃষ্টি করে।
৮. স্থানীয় নির্বাচন : স্থানীয় নির্বাচন বলতে গ্রাম এলাকায় চেয়ারম্যান, মেম্বারের নির্বাচনকে বুঝায়। চেয়ারম্যান ও মেম্বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। একই গ্রামে একাধিক চেয়ারম্যান ও মেম্বারের পদপ্রার্থী থাকে। ফলে একই গ্রামে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। গ্রামের বেশিরভাগ লোক দারিদ্র্য। চেয়ারম্যান ও মেম্বার হওয়ার আশায় অনেকে দরিদ্রদের নিকট থেকে ভোট কিনে নেয়। অনেকে তাদের ভোট একজনের নিকটে বিক্রি করে দিলেও অন্য জনকে ভোট দেয়। এ ধরনের বিষয় জানাজানি হয়ে গেলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আবার একই ব্যক্তি একাধিক পদপ্রার্থীর নিকট ভোট নির্বাচন বিক্রি করে। অনেক সময় কোনো প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী না হলে তারা টাকা ফেরত চায়। এর ফলেও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।পরবর্তী সময়ে জয়ী পক্ষকে বিজিত পক্ষ বিভিন্নভাবে বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করে। এর ফলেও দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
৯. শালিস : গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ সালিস পরিচালনা করে। শালিসের মাধ্যমে গ্রামে বিচার কার্য সম্পাদিত হয়। শালিস গ্রামের একটি ঐতিহ্য বটে। গ্রামের যাবতীয় সমস্যায় শালিস বসানো হয়। শালিসের মাধ্যমে বিবাদের নিষ্পত্তি করা হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে অতি প্রাচীনকাল থেকে শালিস বসে আসছে। এজন্য শালিসের গুরুত্ব অনেক। গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি, চেয়ারম্যান, মেম্বার এ শালিস পরিচালনা করে। সাধারণত প্রভাবশালীর অনুগতদের শালিসের বিচারে অপরাধী প্রমাণিত হলেও তেমন কোনো শান্তি দেয়া হয় না। আবার রাজনৈতিক দলের লোক হলেও অপরাধীর সঠিক বিচার বা শাস্তি দেয়া হয় না। ফলে সাধারণ মানুষ এবং এমনকি নেতৃবর্গের মধ্যে কোন্দলের সৃষ্টি হয়।সাধারণত শালিসের রায়কে কেন্দ্র করে নতুন দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
১০. পোষ্য-পোষক সম্পর্ক : গ্রামের পোষ্য-পোষক সম্পর্ক কোন্দল সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ। গ্রামের এক শ্রেণির লোক অপর শ্রেণির ছত্রছায়া লাভ করে। যারা ছত্রছায়া লাভ করে তারা পোষ্য এবং যারা পোষ্য গড়ে তোলে তারা পোষক।পোষ্য ও পোষক শ্রেণি একে অপরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা প্রদান করে। পোষ্য শ্রেণি সহযোগিতা লাভের মাধ্যমে সহজেই পোষক শ্রেণির প্রতি আনুগত্য পোষণ করে। পোষক শ্রেণি এ সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি করে। এভাবে সমাজে কোন্দলের সৃষ্টি হয়।
১১. ধর্মীয় কারণ : পৃথিবীতে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে। পৃথিবীতে অতি প্রাচীনকাল থেকে এমন কোনো সমাজের অস্তিত্ব মেলেনি, যেখানে ধর্ম ছিল না। আবার ভবিষ্যতে ধর্ম পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন আভাস পাওয়া যায় না। মানুষের নিকট ধর্মের আবেদন চিরন্তন ও শাশ্বত। কিন্তু গ্রামীণ সমাজে ধর্মকে কেন্দ্র করেও কোন্দলের সৃষ্টি হয়। একই গ্রামে একাধিক ধর্মাবলম্বী যেমন- মুসলমান ও হিন্দুরা একত্রে বসবাস করলে তাদের মধ্যে কোন্দলের সৃষ্টি হয়। আবার মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও কোন্দলের সৃষ্টি হয়। মসজিদের ইমাম নির্বাচন,মসজিদ, ঈদগাহের কমিটি নির্বাচন প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
১২. সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বদান : সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বদানের ইচ্ছা ব্যক্তিকে কোন্দলের পথে ধাবিত করে। একই বিষয়ে একাধিক ব্যক্তি নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসলে কোন্দল সৃষ্টি হয়। নেতৃত্বদানের মাধ্যমে একদিকে যেমন সামাজিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়, তেমনি আর্থিক সুযোগ সুবিধাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাভ করা যায়। গ্রামের স্কুল, কলেজ, বাজার, ঈদগাহ প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে একাধিক নেতার উদ্ভব হতে পারে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনায় একাধিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে কোন্দল এর সৃষ্টি হয়।
১৩. রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার : রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার গ্রামীণ কোন্দল সৃষ্টির অন্যতম কারণ।যারা গ্রামের রাজনীতি পরিচালনা করে, তারা অনেক সময় প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত থাকে। তারা অন্যায়ভাবে দুর্বলকে শোষণ করে। আবার গ্রামের নেতৃবৃন্দের পক্ষপাতিত্বের ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পায় না। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই কোন্দলে লিপ্ত হয়। সাধারণত গ্রামের নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একপক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। অতিষ্ঠ জনগণ দ্বন্দ্ব সংঘাতের অপেক্ষায় থাকে। তারা সুযোগ পেলেই দ্বন্দ্বে মেতে ওঠে।
১৪. সেচ সংক্রান্ত বিরোধ : গ্রামের সবাই ব্যয়বহুল সেচকার্য ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালনা করতে পারে না।গ্রামের মুষ্টিমেয় জনগণ সেচকার্য পরিচালনা করে। সেচকার্য পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ সমাজে বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে। সেচের জন্য তাদের উপর সাধারণ জনগণ নির্ভরশীল থাকে। সেচ পরিচালনাকারী ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে বিভিন্ন কারণে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। আবার সেচের পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য নালার প্রয়োজন হয়।যেসব ক্ষেত্রে নালা থাকে না, সেক্ষেত্রে অন্যের জমির উপর দিয়ে সেচের পানি নিয়ে যেতে হয়। অন্যের জমির উপর দিয়ে সেচের পানি নেওয়া হলে বিরোধের সৃষ্টি হয়।
১৫. সরকারি কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ : দেশের সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের সাথে কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োজিত থাকে। তারা গ্রামীণ কোন্দলের সূত্র ধরে লাভবান হয়। কোনো পক্ষের সাথে তাদের যোগসূত্র থাকে এবং তাদেরকে কোন্দলে উৎসাহিত করে। থানার কর্মকর্তারা গ্রামের কোন্দলরত গোষ্ঠীকে মামলায় জড়াতে পারে। তারা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে গ্রামের জনসাধারণের নিকট থেকে উৎকোচ আদায় করে। আবার গ্রামের জনসাধারণকে মামলায় জড়ানোর মাধ্যমে তারা বিভিন্নভাবে সুবিধা আদায় করে।
১৬. মূল্যবোধের পরিবর্তন: সমাজে মূল্যবোধের পরিবর্তন কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোন্দলের সৃষ্টি করে। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামের যুবকরা নতুন চিন্তাচেতনার বশবর্তী হয়। তারা গ্রামে নতুন জ্ঞানের সঞ্চার করে। শিক্ষিত যুবক শ্রেণি গ্রামের পুরাতন ধ্যানধারণার পরিবর্তন প্রয়াসী। কিন্তু যারা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে না তারা পুরাতন ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। এরূপ মূল্যবোধের তারতম্যের কারণে গ্রামীণ সমাজে কোন্দলের সৃষ্টি হয়।
১৭. ব্যক্তিগত বিরোধ : ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বিরোধের ফলে কোন্দলের উৎপত্তি হয়। মানুষ অর্থ, সম্মান, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগী ব্যক্তির সাথে কলহে লিপ্ত হয়। এ ধরনের কোন্দল বড় আকার ধারণ করে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বিরোধ থাকলেও তাদের নিজ নিজ সমর্থকদের নিয়ে দল গঠন করতে দেখা যায়। ব্যক্তিগত অর্থ, সম্পদ, মর্যাদার আঘাত হানলে কোন্দলের সূত্রপাত হয়। একই গ্রামের ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধ ছাড়াও পাশাপাশি বা ভিন্ন ভিন্ন গ্রামের ব্যক্তিদের মধ্যেও বিরোধ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধ দুটি গ্রামের বিরোধে পরিণত হতে পারে। গ্রামের সব ধরনের লোক এ ধরনের ব্যক্তিগত বিরোধে লিপ্ত হতে পারে।
১৮. ব্যবসায়িক বিরোধ : গ্রামীণ সমাজে কৃষির পাশাপাশি কিছু কিছু লোক ব্যবসায় বাণিজ্যের সাথে যুক্ত থাকে।একই গ্রামে একাধিক ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় করে। এসব ব্যবসায় কৃষি পণ্যের ব্যবসায় থেকে শুরু করে আদম ব্যবসাও হতে পারে। বিদেশে লোক পাঠানোর জন্য টাকা নিয়ে শেষে ঐ ব্যক্তিকে অনেক অসৎ আদম ব্যবসায়ী বিদেশে তাদেরকে পাঠায় না। ফলে ব্যবসায়ী ও বিদেশগামীর মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। আবার একই কৃষকের নিকট থেকে একাধিক ব্যবসায়ী একই পণ্য ক্রয় করতে উদ্যত হলেও দু’জন ব্যবসায়ীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
১৯. বিবাহ সংক্রান্ত সমস্যা : গ্রামীণ সমাজে বিবাহের মাধ্যমে পরিবার তথা সমাজজীবন গড়ে ওঠে। কিন্তু বিবাহকে কেন্দ্র করে গ্রামে বিভিন্ন ধরনের কলহ বিবাদের সৃষ্টি হয়। যৌতুকের দাবি, ডিভোর্স, ধর্ষণ, সন্তানসন্ততির বৈধতা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে কোন্দলের সৃষ্টি হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রাম এক সময় শান্তিপূর্ণ পরিবেশের আধার ছিল।তাদের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। সুখে শান্তিতে তারা বসবাস করতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চিন্ত জিগতের পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ এখন অনেক বাস্তবমুখী। কাউকে সামান্যতম ছাড় দিতে তারা অপ্রস্তুত। অসম
অর্থব্যবস্থা, ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতা প্রদর্শন প্রভৃতি নানাবিধ কারণে গ্রামীণ সমাজে কোন্দলের সূত্রপাত। এর পরিণতি কখনো ইতিবাচক হতে পারে না। কোন্দল গ্রামীণ সমাজকে বিষিয়ে তোলে, ভেঙ্গে ফেলে একটি সাজানো পরিবার, ধূলিসাৎ করে মানুষের একটি সাজানো স্বপ্ন, একটি প্রত্যাশা।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*