Answer

কাজী নজরুল ইসলামের নারীবাদী চিন্তাচেতনা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, নারীর অধিকার ও নারীমুক্তি সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলামের মতামত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, কাজী নজরুল ইসলামের নারীবাদী চিন্তাচেতনা বর্ণনা কর।
অথবা, কাজী নজরুল ইসলামের নারীবাদী চিন্তাচেতনা তুলে ধর।
অথবা, কাজী নজরুল ইসলামের নারীবাদী চিন্তাচেতনা আলোচনা কর।
উত্তরা।৷ ভূমিকা :
পৃথিবীর অনেক দার্শনিক আছেন যাঁদের দার্শনিক চিন্তাধারার সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। তাঁদের দার্শনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন কাব্যে, গানে, উপন্যাসে ও নাটকে। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ সাহিত্যিক S.T. Colridge বলেছেন “No man was ever yet a great poet without being at the same time a profound philosopher.” এ প্রেক্ষাপটে কবি ও শিল্পী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের নাম উল্লেখ করা যায়। যুগমন্ত্রণার সার্থক প্রতিফলন নজরুল কাব্যে মূর্ত হয়েছে। তাঁর গান ও কবিতায় তিনি যুগপৎভাবে বিভিন্ন যুগের, বিভিন্ন দেশের জনজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সামনে টেনে এনেছেন এবং নিজেকে আঞ্চলিকতার সীমা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতার ব্যাপক পরিসরে টেনে নিয়েছেন। সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মানবাত্মার মুক্তির লক্ষ্যে তিনি তাঁর সৃজনশীল প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন।
নারীবাদী চিন্তাচেতনা : কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নারীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার। তাঁর লেখনীর মাধ্যমেই। তাঁর নারীবাদী চিন্তাচেতনার মূর্ত রূপ প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নে তাঁর নারীবাদী চিন্তাচেতনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো :
১. নারী-পুরুষের সমতা : নজরুলের মতে, শিক্ষাদীক্ষা ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষ সমান। তিনি আরও বলেন, যে শিক্ষা একজন পুরুষকে দক্ষ অভিভাবকে পরিণত করে, সে একই শিক্ষা একজন নারীকেও একই মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে পারে। কারণ নারী-পুরুষের মৌলিক শক্তি ও গুণাবলি অভিন্ন। সুতরাং নারী-পুরুষের জন্য চাই সমান সুযোগ সুবিধা।
২. নারীর অধিকারে সোচ্চার : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মনীষী যেমন বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝ থেকে নারীসমাজের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিখেছেন ও সংগ্রাম করেছেন, কাজী নজরুল ইসলামও তাই করেছিলেন। মানবতাবাদী দার্শনিক মাত্রই যেমন নারী-পুরুষের ন্যায্য অধিকারের সমর্থক, নজরুলও ঠিক তাই। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য দুঃখ মোচনের জন্য যেমন নারী অধিকারেও তেমনি তিনি সোচ্চার।
৩. নারী-পুরুষের সমানাধিকার : নজরুল সমাজের শোষিত বঞ্চিত ভাগ্যাহতদের পক্ষে যেমন কাজ করেছিলেন, তেমনি সচেতন ছিলেন নারীর অধিকার ও নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে। নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তাঁর অতি পরিচিত বাণী-
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
৪. শ্রদ্ধার আসনে নারী : নজরুল তাঁর বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে নারী জাতিকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। তাঁর মতে, উপমহাদেশের নারীরা অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত। তাই তিনি তাদের রক্ষার জন্য, সমাজের সকল বিবেকবান মানুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
৫. নারী শিক্ষা : কাজী নজরুল ইসলাম নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস দূর করার কথা বলেন। তাঁর মতে, এ কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের জন্য বাঙালি নারীরা আজ বিশ্বের দরবারে অবহেলিত। তাই তিনি বাঙালি নারীকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরামর্শ দেন।
৭. মানবতাবাদী চিন্তাধারা : কাজী নজরুল ইসলাম একজন মানবপ্রেমিক দার্শনিক। মানুষকে নিয়েই তাঁর দর্শন। তাঁর দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে নারী। নারীরা যে সমাজে অবহেলিত, শোষিত, নির্যাতিত তা তিনি অনুধাবন করেছিলেন । এ থেকে মুক্তির জন্য তাই মানবপ্রেমিক নজরুল নারী জাতির শিক্ষার কথা বলেন।
৮. অর্থনৈতিক ভিত্তি : নজরুলের মতে, নারীসমাজের অনগ্রসরতার মূল কারণ হলো তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল। তাই তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য তিনি নারীসমাজকে শিক্ষিত হওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, অর্থনৈতিকভাবে নারী স্বাবলম্বী হলে সমাজ থেকে তাদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন অনেকাংশে কমবে।
৯. বিভিন্ন ধর্মে নারীর অবস্থান : বিভিন্ন ধর্মে নারী সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। এর মধ্যে ইসলামে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। হিন্দুধর্মে নারীকে পুরুষের অধীনে থাকতে বলা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মে সমাজে ব্যভিচারের জন্য নারীকে দায়ী করা হয়েছে। হিন্দুধর্ম ও খ্রিস্টানধর্মে নারী সম্পর্কে যে মতামত তাতে নজরুল দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, সমাজে নারী-পুরুষ সমান। ইসলাম ধর্ম নারী-পুরুষের সমতার কথা বলে। তাই নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, নজরুলের রচনার একটি বিশেষ অংশ জুড়ে ছিল নারী। তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় নারী জাতির বিদ্যমান দুঃখদুর্দশা নিখুঁত শিল্পীর মতো চিত্রায়িত করেছেন। নারী জাতি তাদের ইঃখদুর্দশা থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারে সে সম্পর্কে তিনি সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাই বলা যায়, নজরুলের মানবসেবা শুধুমাত্র ব্যক্তিমানুষের মর্যাদা সংরক্ষণ নয়; সমাজ, রাষ্ট্র তথা একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!