কাজী নজরুল ইসলামের জীবনদর্শন ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নজরুলের দর্শনচিন্তা আলোচনা কর।
অথবা, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নজরুলের দর্শনচিন্তা তুলে ধর।
অথবা, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নজরুলের দর্শনচিন্তা বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : কাজী নজরুল ইসলামের আত্মপ্রকাশ একজন সুপরিচিত কবি হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে নয়। তবে তাঁর দার্শনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন কাব্যে, গানে, উপন্যাসে ও নাটকে। নজরুল নিজেকে আঞ্চলিকতার সীমা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতার ব্যাপক পরিসরে নিয়ে গেছেন তাঁর অবদানের দ্বারা। নজরুল প্রতিভার সবচেয়ে বড় দিক হলো তিনি সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, রীতিনীতি, আইনকানুন কোনোকিছু বিসর্জন দিতে বলেননি। সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি তাঁর সৃজনশীল প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সমাজের জন্য মানুষ নয়, বরং মানুষের জন্য সমাজ।
নজরুলের জীবনদর্শন : জীবনের সাথে দর্শনের জীবনকেন্দ্রিক অর্থ ও ব্যঞ্জনার নিরিখেই সম্পৃক্ততার উপর জোর দেওয়ার জন্য বলা হয়। সার্থক দর্শন মানেই জীবনদর্শন। নজরুলের কবি জীবন সাধারণভাবে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ দিক থেকে শুরু হয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মানবকল্যাণে আত্মনিবেদিত দার্শনিক মাত্রই যেমন দর্শনকে রসকসহীন বিশুদ্ধ তত্ত্বের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে যুক্ত করতে চান সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও হাসি- কান্নার বাস্তব জীবনের সাথে, নজরুলও ঠিক তেমনি কাব্যসাহিত্যকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন বিশুদ্ধতার সংরক্ষিত এলাকা থেকে এবং পৌঁছে দিয়েছেন নিপীড়িত রিক্ত মানুষের ঘরে। নজরুল সারাজীবন ছিলেন সত্যের সাধক, সত্যকে অকপটে স্বীকার করতে তিনি কখনও পিছপা হননি। সেজন্য তিনি সৎ কবি ও চিন্তাশীল। নিজ চিন্তা ও ধ্যানে যাকে সত্য বলে অনুভব করেছেন, তাকে প্রকাশ করতে কখনও দ্বিধা করেননি।
আত্মশক্তি ও দ্রোহচেতনা : নজরুল ছিল ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। তিনি যতটা রোমান্টিক ছিলেন, ততটা ছিলেন বৈপ্লবিক। তাঁর বৈপ্লবিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় ।
“আমি দুর্বার
আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!”
নজরুলকে কেন্দ্র করে বাঙালি তার গতানুগতিক জড়তা ও আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সচল ও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিদেশি শাসনের গ্লানি, বঙ্গভঙ্গ, খেলাফত আন্দোলন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় নজরুলের কবি মানস। তিনি শুধু প্রতিবাদী ছিলেন না, তিনি ছিলেন আত্মনিষ্ঠাবান। তিনি বলেছেন, আমার কর্ণধার আমি। সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজনে, বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসন শোষণে জর্জরিত একটি প্রাণস্পন্দনহীন জাতিকে তাঁর মোহনিদ্রা থেকে জাগানোর লক্ষ্যেই তিনি জয়গান করলেন বিদ্রোহ, আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির। আত্মসত্তার শক্তির প্রতি সমর্থন দিয়ে তিনি ধূমকেতুতে বলেছেন,
“আমি যা ভালো বুঝি,
যা সত্য বুঝি,
শুধু সেইটুকু প্রকাশ করব,
বলে বেড়াব,
তাতে লোকে নিন্দা যতই করুক,
আত্মপ্রবঞ্চনা করে আর আত্মনির্যাতন ভোগ করব না।”
নজরুলের সেবাধর্ম : নজরুল জন্ম নিয়েছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। স্বাভাবিকভাবেই নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, দরিদ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাঁর কাব্য ও গানে বাণীরূপ পেল। তিনি বর্ণনা করেছিলেন, মানুষের সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্বের কথা। মানুষকে ভগবাননির্ভর না হয়ে আত্মসচেতন হওয়ার ডাক দিয়ে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানালেন। তিনি অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন এবং মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধনে মুখর হয়ে উঠলেন-
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!”
নজরুলের মতে, “ধর্মের কথাই বলি আর দর্শনের কথাই বলি, সর্বত্রই মানুষ বিবেচিত মানুষ হিসেবে। শোষিত, অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানব অস্থিও উদ্দাম হয়ে উঠেছে আত্মসচেতন বিদ্রোহে।” তাঁর মতে, মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে অনৈক্য দুঃখজনক। নজরুল নবজাগরণের উৎস আবিষ্কার করেছেন। যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী সৃষ্টিশীল কুলি মজুরদের বেদনার পথেই নবযুগের পদধ্বনি শুনেছেন। তিনি বলেন,
“তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাদেরই গান
তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে মহা উত্থান
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।”
যারা বিভেদ করে নজরুল তাদের প্রতিহত করেন। তিনি বলেন, দরিদ্র, অশিক্ষিত বলে কিংবা বিশেষ সম্প্রদায়ে জন্মেছে বলে কাউকে দূরে সরিয়ে রাখা অন্যায়। নজরুলের ধারণা নিপীড়িত, প্রবঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষের অন্তরে আত্মচেতনা প্রজ্বলিত হলেই তারা শয়তানের উচ্ছেদ সাধন করে সৃষ্টিকে সুন্দর ও স্বাভাবিক করতে সমর্থ হবে। এ আত্মচেতন মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এ বিদ্রোহ ভগবানের সৃষ্টি ধ্বংসকারী দৈত্যসদৃশ অত্যাচারী এক দল মানুষের বিরুদ্ধে।
নারীসমাজের অধিকার : নজরুল ভারতীয় ভাবধারার আদর্শে নারীকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। তিনি নারীর মধ্যে বিশ্বের শুভংকরী শক্তি আবিষ্কার করেছেন এবং তাকে সমাজ এবং সভ্যতার অন্যতম নির্মাণকারিণী বলে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন। নারীর প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ অভিনন্দন অভিনিবেশযোগ্য।
“জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,
সুখম-লক্ষ্মী নারীই ফিরেছে রূপে রূপে সঞ্চারী।”
তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য যেমন সোচ্চার ছিলেন, দুস্থ মানবতার দুঃখমোচনে যেমন সোচ্চার ছিলেন, তেমনি নারী অধিকারের ব্যাপারেও নজরুল সোচ্চার ছিলেন। নজরুলের অন্তরে মানবতাবোধ ছিল, যার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি অবলম্বন করেন শোষিত, বঞ্চিত, ভাগ্যাহতদের পক্ষ। এটাই তাঁকে সোচ্চার করেছিল নারী অধিকার ও নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর অতিপরিচিত বাণী-
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
নজরুল নারীর কল্যাণ শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর বিদ্রোহ ও শৌর্য-বীর্যের মূলে যেসব মনোবৃত্তি ছিল, তাদের মধ্যে নারীপ্রেম অন্যতম। শেলীর সাথে এখানে তাঁর অন্তরঙ্গ মিল দেখা যায়। Andre Maurois শেলীর প্রসঙ্গে লিখেছেন-
“His personal experience had
Taught him that only the
Love of a woman can
Inspire a sublime courage.”
মানুষের গড়া অত্যাচার, পরাধীনতা, কুসংস্কার, স্বার্থপরতার চক্রান্ত থেকে নারীকে উদ্ধার করে তিনি তাকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর। তিনি বলেছেন,
“জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা!
জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্ত টীকা!!”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, দার্শনিক নজরুল তাঁর সাহিত্যে মানুষের কথা, জীবনের কথা, দেশের কথা, জগতের কথা, প্রেমের কথা, স্রষ্টার কথা, নীতির কথা প্রভৃতি সুন্দররূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। নজরুলের মানবসেবা যে শুধু ব্যক্তিমানুষের মর্যাদা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা নয়, বরং বলা যায়, সমাজ, রাষ্ট্র তথা একটি সুন্দর বিশ্ব গড়ার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত। তাঁর এ প্রেমানুভূতি তাঁকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে প্রিয় হতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে।