Answer

কাজী আব্দুল ওদুদের রাষ্ট্রদর্শন ব্যাখ্যা কর।

অথবা, রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে কাজী আব্দুল ওদুদের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে কাজী আব্দুল ওদুদের অবদান আলোচনা কর ।
উত্তর৷। ভূমিকা :
শিক্ষাবিদ ও প্রগতিশীল চিন্তানায়ক কাজী আব্দুল ওদুদ মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা ও মননশীল লেখক হিসেবে বাংলাদেশ দর্শনে সুপরিচিত। তাঁর চিন্তাচেতনায় জার্মান কবি গ্যাটে, রাজা রামমোহন রায়, মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ প্রভাব লক্ষণীয়। তিনি পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগ্রত করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন।
কাজী আব্দুল ওদুদের রাষ্ট্রদর্শন : আব্দুল ওদুদ নিজে কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তবে তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন। রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল স্বচ্ছ এবং দূরদর্শী। ১৯২০ এর দশক হতে ১৯৭০ এর দশক পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময়ের আলোচিত ঘটনাসমূহ হচ্ছে ১. ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ ২. ১৯১১ এর বঙ্গভঙ্গ রদ ৩. ১৯১৪ এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ৪. ১৯১৯ এর স্বদেশী আন্দোলন ৫. ১৯২১ এর অসহযোগ আন্দোলন ৬. ১৯৩৯ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ৭. ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগ ৮. ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং ৯. সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ঘটনাবহুল এ সময়ে কাজী আব্দুল ওদুদ তাঁর দর্শন চিন্তা চালিয়ে গেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর চিন্তাচেতনায় ‘রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছে। নিম্নে বিস্তারিতভাবে তাঁর রাষ্ট্রদর্শন ব্যাখ্যা করা হলো :
১. গান্ধীর মতের সাথে সাদৃশ্য : রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে গান্ধী যেমন অহিংস নীতিকে গ্রহণ করেছিলেন, ঠিক তেমনি আব্দুল ওদুদ রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে অহিংস নীতিকে সমর্থন করেছেন। গান্ধীর আদর্শের তিনটি নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে- সত্যাগ্রহ, অহিংসা এবং চরকা। ১৯২১ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ’-এ এ বিষয়ে তাঁর সমর্থন পাওয়া যায়। আব্দুল ওদুদ বুঝতে পেরেছিলেন যে, হিংসা বা হানাহানি বা যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান হয় না। তাঁর মতে, প্রেমের মাধ্যমেই কোনোকিছুর সমাধান করা সহজ। তিনি কখনও ভারত বিভক্তি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ভারতবাসীর মধ্যে প্রেমের উদ্রেক ঘটাতে। সবার মধ্যে যদি প্রেম থাকে তাহলে কেউ কারও খারাপ চাইবে না এবং এভাবে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
২. অসাম্প্রদায়িক চিন্তা : আব্দুল ওদুদ সাম্প্রদায়িকতাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গড়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেননি। জিন্নাহ সাহেব যেখানে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাস ভূমির দাবি করলেন সেখানে ওদুদ অবিভক্ত ভারতের ঐক্যের কথা বলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক বিশুদ্ধ জাতীয়তা সমর্থন করেন। ‘হিন্দু-মুসলমানদের বিরোধ’ নামক এক বক্তৃতায় তিনি একটি বিখ্যাত উক্তি করেন। উক্তিটি হচ্ছে, “ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা নয়; জ্ঞান ও জাতীয়তা দেশের লোকের শরণ্য হবে।” তিনি যেহেতু ভারত বিভক্তিকে কখনও মনেপ্রাণে মেনে নেননি সেহেতু বাংলাদেশে তাঁর পিতৃভূমি থাকা সত্ত্বেও ভারত বিভক্তির পর বাংলাদেশে ফিরে আসেননি।
৩. ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ : আব্দুল ওদুদ বলেছেন, বিভক্তি যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে, তবে ভাষাভিত্তিক বিভক্তি হওয়া ভালো। কারণ একই ভাষা ও সংস্কৃতির লোকের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির ভাব গড়ে তোলা যায় খুব সহজে।হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে যেভাবে ভারত বিভক্ত হলো তাকে তিনি মোটেই মেনে নিতে পারেননি। বিশেষ করে বাঙালিদের সাথে ভিন্নভাষী পাকিস্তানিদের একই সাথে রেখে যে বিভাগ রেখা টানা হলো তা ছিল নিতান্তই অদূরদর্শিতার ফল। কারণ বাঙালি সংস্কৃতির সাথে পাকিস্তানিদের সংস্কৃতি মিলে না। এ সম্পর্কে তিনি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একটি উক্তি করেছেন। উক্তিটি হচ্ছে, “পাকিস্তানে ধর্মকে রাজনীতি ও অর্থনীতির পুঁজি করে চালানো হচ্ছে, ইতিহাস বিরুদ্ধ, ভূগোল বিরুদ্ধ এ জোড়া ভাঙবে।” তাঁর এ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রমাণ আজ আমাদের সামনেই উপস্থিত।
৪. ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ : তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন না। তিনি যে কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ইসলামি রাষ্ট্র হলো সে রাষ্ট্র সেখানে শুধু মুসলমানরাই সুযোগ সুবিধা বেশি ভোগ করবে। কিন্তু রাষ্ট্র কোনো একক জাতিগোষ্ঠীর সংগঠন নয়, একটি রাষ্ট্রে সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতির লোক থাকতে পারে।তাদের প্রত্যেকেরই জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গঠনের কাজে নিয়োজিত হতে হবে। শরিয়তের পুনঃপ্রতিষ্ঠা যে একেবারে অসম্ভব সে কথা তিনি স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “শরিয়তের পুনঃপ্রবর্তন অবশ্য অসম্ভব। কেননা অতীত অস্তমিত মৃত তার যে অংশ সজীব সে তুমি ও আমি; অতীত পুনরুজ্জীবিত হবে না।”
৫. প্যান ইসলামবাদ বিরোধী মত : আব্দুল ওদুদ জাতীয় জীবনে যেমন ইসলামি রাষ্ট্রকে সমর্থন করেননি, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্যান ইসলামবাদ সমর্থন করেননি। এ প্রসঙ্গে ‘মুস্তাফা কামাল সম্পর্কে কয়েকটি কথা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “প্যান ইসলামি চিন্তা মুসলমানকে বহির্মুখী করে তোলে এবং স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি উদাসীন করে, মুসলমানদের স্বদেশ ও স্বজাতির দুঃখ দৈন্যের অবসানের চিন্তা করা উচিত। প্যান ইসলামবাদ নয়; বাস্তব জাতীয়তাবাদই মুসলমানদের কাম্য।” এ রকম দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনকেও সমর্থন করেননি। তিনি জাতীয় ও আন্ত জাতিক উভয় ক্ষেত্রে ঐক্যের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ঐক্য ছাড়া বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুতরাং একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রকে সকল রকম সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে হবে। এ কারণেই। তাঁকে প্রায়ই ‘জর্জ বার্নার্ড শ’ এর একটি বিখ্যাত উক্তি উচ্চারণ করতে শোনা যেত। উক্তিটি এ রকম, ” Let us live rationally and nationally.” 13
৬. কল্যাণকামী রাষ্ট্র : রাজনীতি সম্পর্কে উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে তিনি যে রাষ্ট্রকে সমর্থন করেন তার একটি পরিচয় তিনি তুলে ধরেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে পুরোপুরি সমর্থন করেননি। তিনি বলেছেন, সমাজতন্ত্রে যে সাম্যবাদের কথা বলা হয় সেটা ভালো, কিন্তু এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকে না। আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য না থাকলে ব্যক্তির স্বাধীন মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের, যেখানে একই সাথে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকবে এবং অর্থনৈতিক সমতাও বিরাজ করবে।অর্থাৎ এককথায় বলা যায়, তিনি সাম্যবাদের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশ দর্শনে যে ক’জন দার্শনিক তাঁর স্বীয় প্রজ্ঞা ও মৌলিক দার্শনিক মতের জন্য বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন তার মধ্যে কাজী আব্দুল ওদুদ অন্যতম। তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, যেখানে থাকবে না সম্পদের বণ্টনের সমস্যা এবং সে সাথে ব্যক্তি স্বাধীনতাও বজায় থাকবে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!