ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী আলোচনাপূর্বক তাঁর রাজনৈতিক অবদানসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তাঁর অবদান উপস্থাপন কর।
অথবা, ইন্দিরা গান্ধীর পরিচয় দাও। তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, ইন্দিরা গান্ধীর সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখ। রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান সবিস্তারে
ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় উপমহাদেশের নারী নেতৃত্বের কথা বলতে গেলে আলোচনার শীর্ষে যাদের নাম আসে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। নারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি ভারতের রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয় অবদান রেখে গেছেন। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীরাও যে পুরুষদের সমান অবদান

রাখতে পারে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব অনেক পুরুষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও হার মানিয়েছে। তিনি ছিলেন পিতা জওহরলাল নেহেরুর সুযোগ্য কন্যা। যথেষ্ট ধনী পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও, নিজের সকল সুখশান্তি বিসর্জন দিয়ে তাঁর বাবা সারাজীবন দেশের কল্যাণে দেশের সংগ্রামী জনগণের
পাশেই দাঁড়িয়েছেন । ইন্দিরা গান্ধীও অনুরূপভাবে দেশের কল্যাণে সারাজীবন কাজ করে গেছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : ইন্দিরা গান্ধী ১৯১৭ সালে সুযোগ্য পিতা জওহরলাল নেহেরুর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামাতার একমাত্র সন্তান। ধনী নেহেরু পরিবারের প্রাচুর্যের মধ্যেই তিনি বড় হতে থাকেন। জওহরলাল নেহেরু ব্যস্ত থাকায় তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক কারণে তাঁকে প্রায়ই গৃহ ও জেলখানায় আসা যাওয়া করতে হতো। বিদেশে অবস্থানের সময় ইন্দিরার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই তিনি মারা যান। ফলে মাতৃহারা হয়ে পড়েন ইন্দিরা। বড় হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো তাঁকে প্রভাবিত করতে থাকে। এক পর্যায়ে তাঁর বাবা মেয়েকে নিয়ে বিশেষত মেয়ের স্বভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ পিতা ও কন্যার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলাদা। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় সমস্যা অবলোকনের ক্ষেত্রে নেহেরুর দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে ছিল দীর্ঘমেয়াদি সেখানে তাঁর কন্যা অধিক মনোযোগ দিতেন আশু সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে। ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। দেশের সমস্যাগুলো তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে সুষ্ঠুভাবে সমাধানের চেষ্টা করতেন। কাশ্মীর সমস্যা সম্পর্কে তাঁর অত্যন্ত বাস্ত বধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল । ১৯৬৬ সালে ৪৯ বছর বয়সে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। অবশেষে ১৯৮৪ সালে মাত্র ৬৭ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক অবদানসমূহ : দেশ ও জাতির কল্যাণে ইন্দিরা গান্ধী সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। জাতীয় স্বার্থরক্ষা করেই তিনি সকল ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করতেন। দেশ ও জাতির কল্যাণের লক্ষ্যে তাঁর বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড ও অবদানসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ইন্দিরার সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা : ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দক্ষতা জনসমক্ষে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। উক্ত নির্বাচনে যুবসমাজের সমর্থন আদায়ের জন্য ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনী প্রচারে বামপন্থি অবস্থান গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
চেয়ে বরং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকেই বেশি প্রাধান্য দেন। তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করেন। কংগ্রেস সিন্ডিকেট আবারও হতাশাগ্রস্ত হয় ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট ফকরুদ্দীন আলী আহমেদের মৃত্যু হলে এ সময় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেস সিন্ডিকেটের মধ্যে দেখা দেয় মতানৈক্য। নির্বাচনে অবশ্য ইন্দিরা গান্ধীর মনোনীত প্রার্থী ডি. ভি. গিরিই জয়লাভ করেছিলেন। আর এটাই ছিল কংগ্রেসের হতাশার কারণ। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। এভাবেই তাঁর বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডে আমরা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার পরিচয় লক্ষ্য করি।
২. জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধী : ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সম্মোহনী নেতৃত্বের অধিকারিণী। সাধারণ জনগণের সাথে সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। দেশের জনসাধারণের ভালোবাসাই তাঁর দলীয় অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছিল। আর এ কারণেই তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় না করে সরাসরি দেশের জনগণের কাছে আবেদন জানাতে পারতেন। আর তাই ইন্দিরার পক্ষে ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসে যে বড় ধরনের বিভক্তি সূচিত হয় তা অতিক্রম করা সহজ হয়েছিল। একই কারণে দলীয় ব্যক্তি বর্গকেও উপেক্ষা করে তিনি ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হন। এটি তাঁর সম্মোহনী নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তার পরিচয়ই বহন করে।
৩. সাহসী ও সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী : দেশের সংকটকালীন পরিস্থিতিতে ইন্দিরা গান্ধী সর্বদা সাহসী ও সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর পরিচয় দিয়েছেন। ষাটের দশকে ভারতে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে সময়ে দেশের গ্রামাঞ্চল ও কৃষিক্ষেত্রে সরকারের তেমন একটা সুদৃষ্টি ছিল না। ইন্দিরা সরকার ক্ষমতায় এসে এদিকে দৃষ্টি দেন। তিনি নতুন কৃষিনীতি
প্রবর্তন করেন। তিনি চাষিদেরকে নতুন ও অধিক ফলনশীল চা ও ধানের বীজ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ক্ষমতা নয় প্রবৃদ্ধি অর্জনই ছিল তাঁর এ নতুন কৃষিনীতির লক্ষ্য। বিশ্বব্যাংক ভারতের এ নিবিড় খাদ্য উৎপাদন কর্মসূচির অর্থসংস্থানের জন্য ভারতীয় ‘রুপি’র অবমূল্যায়ন দাবি করে এবং শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করার। এক্ষেত্রে তাঁর সরকারের কতিপয় আস্থাভাজনদের সাথে আলাপ আলোচনা করে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রুপির অবমূল্যায়নের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ কারণে কংগ্রেসে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং অনেক কংগ্রেস নেতা দল ছেড়ে চলে যান। এছাড়াও ইন্দিরা গান্ধীর আরেকটি নীতিও সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। সেটি হলো তাঁর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নীতি।
এক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনড়। ইন্দিরা গান্ধী একথা জোর গলায় বলেছেন যে, এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সাথে দেশের মূল অংশের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা।
৪. বিশ্ব নেতৃত্ব হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী : শুধু ভারতের রাজনীতিই নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাঁর কৃতিত্ব ছিল অসাধারণ । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও তিনি সমানভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা সম্পর্কে তিনি উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে সর্বদা অবহিত করতে সচেষ্ট থাকতেন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি। উন্নয়নশীল দেশসমূহের নারীসমাজের অধস্তনতা ও দুঃখদুর্দশার কথা তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইন্দিরা গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে তাঁর ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। নারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরাও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। তাই তিনি নারী জাতির আদর্শ ও গৌরব। ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি তাঁর জীবন আরাম আয়েশের মধ্যে কাটিয়ে দেন নি। বরং দেশের সাধারণ জনগণের সাথে থেকে তাদের দুঃখদুর্দশায় সর্বদা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এভাবেই দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি তাঁর সারাটা জীবন ব্যয় করে গেছেন।।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a7%8d/

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*