অর্থনৈতিক মতবাদের আলোকে মার্কসীয় নারীবাদ আলোচনা কর।

অথবা, অর্থনৈতিক মতবাদের সাথে মার্কসীয় নারীবাদের সম্পর্ক আলোচনা কর।
অথবা, অর্থনৈতিক মতবাদের আলোকে মার্কসীয় নারীবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদে কী বলা হয়েছে উল্লেখ কর।
অথবা, অর্থনৈতিক মতবাদের সাথে মার্কসীয় নারীবাদের সম্পর্ক সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, মাকর্সের অর্থনৈতিক মতবাদ বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মার্কসীয় ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী প্রবক্তাগণ বিশ্বাস করেন যে, নারীনির্যাতন ব্যক্তির স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডের ফল নয়, বরং ব্যক্তি যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বাস করে সে কাঠামোর ফলশ্রুতি। পরিবার ও কর্মস্থলে নারীর ভূমিকা যদি পুরুষের অধীন করে না রাখত, তাহলে তার মনমানসিকতা অন্যরকম হতো। নারীর বর্তমান অবস্থান ও কাজকর্ম যা তার মধ্যে হীনতার চেতনাবোধ সৃষ্টি করেছে। তার অস্তিত্ব ধনিকতন্ত্রের অন্তর্গত। নারীর বর্তমান অবস্থার মাধ্যমে হয়েছে পুঁজিবাদের জন্ম। কাজেই ধনিকতন্ত্র নারীর অবস্থান ও ক্রিয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে হিনমন্য চেতনাবোধ সৃষ্টি করেছে। তাই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতবাদে ব্যাপকভাবে নারী স্থান পেয়েছে।
মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদ : মার্কস ধনিকতন্ত্রকে শোষণ ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করেন। এ ব্যবস্থায় শ্রমিকের শ্রম দ্বারা পণ্য উৎপাদন হয়, কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের মূল্য শ্রমিকের মজুরির সমান না হয়ে বেশি দাম নির্ধারিত হয়। মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও নারীবাদকে নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো :
১. উদ্বৃত্ত মূল্য : মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদে মালিক উৎপাদিত পণ্যের মূল্যনির্ধারণ করে। শ্রমিকের মজুরির অতিরিক্ত যে মূল্য সে বিক্রয় করে পায়, তা মালিকের লাভ। মালিকের লাভ বস্তুত শ্রমের মূল্যের শোষণ, শ্রমিকের শোষণ। শ্রমিকের মজুরি ও পণ্যের দাম, এ দু’য়ের ব্যবধানকে মার্কস বলেছেন উদ্বৃত্ত মূল্য। মালিক শ্রমিককে বঞ্চিত করে এ উদ্বৃত্ত মূল্য ভোগ করে। এ উদ্বৃত্ত মূল্য পুঁজিবাদে শোষণের হাতিয়ার। মার্কসের মতে, উদ্বৃত্ত মূল্য যত বেশি হবে, শ্রমিক তত শোষিত হবে এবং নারী নির্যাতনের মাত্রাও বেশি হবে।
২. শ্রম বিক্রয়ের ব্যাপারে স্বাধীন : ঊনবিংশ শতাব্দীর পর থেকে পুঁজিবাদে শ্রমিক তার শ্রম বিক্রয়ের ব্যাপারে স্বাধীন। এখানে শ্রমিক তার ইচ্ছামতো মজুরিতে শ্রম বিক্রয় করার স্বাধীনতা ভোগ করে। সে কি কাজ করবে, কত
মজুরিতে করবে, তা তার ইচ্ছাধীন। মার্কস বলেছেন যে, এ স্বাধীনতা আপাতত স্বাধীনতা, মালিক উৎপাদনের সকল উপকরণের মালিক। শ্রমিককে কাজ করতে হলে মালিকের অধীনে সর্বদা কাজ করতে হবে। মালিক উৎপাদনের উপকরণের একচেটিয়া অধিকারী। মালিক কাজের বিনিময়ে যে মজুরি দিবে সে মজুরিতে কাজ করা ছাড়া শ্রমিকের বিকল্পকোন পথ নেই। তবে শ্রমিক শ্রম বিক্রয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে।
৩. শ্রমিকের স্বাধীনতা : নারী শ্রমিক হলো শ্রমশক্তির একটি বিরাট অংশ। ফলে শ্রমিক হিসেবে নারী গণ্য হয়। তাই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি বলে মালিক শ্রমিককে মালিকের শর্ত ও মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করতে পারে। শ্রমিকের স্বাধীনতা উৎপাদনের উপকরণের উপর তার কর্তৃত্বের অভাবে নিছক কথার কথা, শ্রমিকের তথাকথিত স্বাধীনতা
বাস্তবে অর্থহীন। শ্রমিক প্রকৃতপক্ষে সে কাজ সে মজুরিতে করতে বাধ্য হবে, যে কাজে যে মজুরিতে মালিক তাকে নিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়। তবে শ্রমিকের স্বাধীনতা সমাজতান্ত্রিক মতবাদে রয়েছে।
৪. পতিতাবৃত্তি ও মজুরি : মার্কসীয় নারীবাদী প্রবক্তারা মার্কসের বিশ্লেষণকে নারীর দেহ ও শরীর ব্যবসায় ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করেন। রক্ষণশীলরা দাবি করেন যে, অন্যান্য কাজের চেয়ে এ কাজ পছন্দ করে বলে নারী পতিতা হয়, যৌন ও প্রজনন সেবা বিক্রয় করে। মার্কসীয় দার্শনিকদের দাবি, যে নারী স্বেচ্ছায় দেহ ব্যবসায় করে না, তারা ধনিকতন্ত্রের যাঁতাকলে বাধ্য হয়ে তাদের দেহ বিক্রয় করে। মার্কস গণিকাবৃত্তিকেও একটি পেশা বা কাজ বলে গণ্য করেছেন। মার্কসবাদী নারীবাদের মতে, গণিকাবৃত্তি মজুরি শ্রমের মতোই একটি শ্রেণি সমস্যা। নারী অনন্যোপায় হয়ে তার একমাত্র সেবা দেহ বিক্রয় করতে বাধ্য হয়।
৫. নারীমুক্তি : মার্কসের বিশ্লেষণ নারীবাদীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। তাঁর মতে, বিশ্বের নারী সংঘবদ্ধ হলে, নিজেদের শ্রেণি চরিত্র সম্পর্কে সচেতন হলে, সচেতন নারী সংঘবদ্ধ শক্তিতে নারীনির্যাতন নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে নারীর মুক্তি আসবে। তাই নারীমুক্তির জন্য নারীকে সংগঠিত হতে হবে। নারীকে নিজের বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ মুক্তির লক্ষ্যে সচেতন হতে হবে। কেবল সচেতনতাই নয়, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ও সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
৬. শ্রেণি সচেতনতা : শ্রেণি সচেতনতা সম্পর্কে মার্কসের আশাবাদ মার্কসীয় নারীবাদী প্রবক্তাদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কেবল তাই নয়, নারীমুক্তিতে শ্রেণি সচেতনতার ভূমিকা সম্পর্কে চিন্তাভাবনার উদ্রেক করেছে। কতিপয় নারী বুর্জোয়া পুরুষের স্ত্রী, কন্যা, বন্ধু এবং প্রেমিকা। অন্যদিকে, কতিপয় নারী শ্রমিক শ্রেণির পুরুষের স্ত্রী, কন্যা, বন্ধু এবং প্রেমিকা। এ বিপরীতমুখী নারীদের সম্পর্কে মার্কসীয় নারীবাদীরা বলেছেন যে, ধনিক শ্রেণির হোক, শ্রমিক শ্রেণির হোক, সকল নারীই নির্যাতনের শিকার। নির্যাতনের দুস্থ অভিজ্ঞতায় সকল নারী এক ও অভিন্ন। তাই তাদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, নারী সমাজ ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের প্রতি বৈষম্য দূর হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বন্ধ হবে তাদের প্রতি সকল ধরনের নির্যাতন। নারীমুক্তির মাধ্যমে সমাজকাঠামোর পরিবর্তন আসবে, মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে। তারই সমাজতন্ত্রের আদর্শে নারীদের
বিশ্বাসী হয়ে নিজেদের মুক্তি আনতে হবে, অন্য কোনো উপায়ে সম্ভব হবে না।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*