অবিভক্ত বাংলার মুসলিম জাগরণে বেগম রোকেয়ার অবদান মূল্যায়ন কর।

অথবা, সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান আলোচনা কর।
অথবা, সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া কিরূপ অবদান রাখেন? আলোচনা কর।
অথবা, অবিভক্ত বাংলার মুসলিম সমাজের নারী সমাজের উন্নয়নে বেগম রোকেয়া কি ভূমিকা রেখেছেন? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মুসলিম নারীসমাজের কল্যাণের ক্ষেত্রে যে মহীয়সী নারীর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয় তিনি হলেন বেগম রোকেয়া। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়। বেগম রোকেয়ার জন্মের সময় মুসলিম সমাজে পর্দাপ্রথার খুব কড়াকড়ি প্রভাব ছিল। বেগম রোকেয়া পারিবারিক সকল বাধা অতিক্রম করে ঘরে বসেই ইংরেজি ও বাংলা শিখতেন। এক্ষেত্রে তিনি তার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবির, বড় বোন করিমুন্নেছার সহযোগিতা পেয়েছেন। রোকেয়াকে শিক্ষাজীবনের ভিত্তি রচনা করতে তার বড় ভাই সহযোগিতা করেছেন যেমন, তেমনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্বামী সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষাজীবনের পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন।
অবিভক্ত বাংলার মুসলিম জাগরণে বেগম রোকেয়ার অবদান : অবিভক্ত বাংলার মুসলিম জাগরণের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান অপরিসীম। মুসলিম সমাজের কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন রকম কল্যাণকর কাজ করেছেন যাতে মুসলমান সমাজ তাদের উন্নয়নের পথ খুঁজে নিতে সক্ষম হয়। নিম্নে তার অবদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান : বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের ক্ষেত্রে যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বেগম রোকেয়া হলেন সে নারী যিনি একাধারে সমাজসেবী, সাহিত্যকর্মী, শিক্ষাব্রতী ও সমাজসংস্কারক হিসেবে বিশেষভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

বেগম রোকেয়া অবিভক্ত বাংলার অবহেলিত, বঞ্চিত, অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীসমাজকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের আলোকবর্তিকা দেখাতে পেরেছিলেন।
২. নারীর অধিকার ও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান : মুসলিম সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বেগম রোকেয়া। রোকেয়ার চিন্তা, কর্মধারা প্রভৃতি দিকগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, বেগম রোকেয়া সবসময়ই নারীমুক্তির কথা চিন্তা করেছেন। বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, নারীসমাজের মুক্তির ও অধিকার আদায় করার জন্য প্রয়োজন নারীকে শিক্ষিত করে তোলা। অবহেলিত ও অবরোধ বাসিনী মুসলিম মেয়েদের সচেতন ও সংঘবদ্ধ করার জন্য তিনি ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য একটাই মুসলিম নারীসমাজের দুঃখদুর্দশা দূর করা। ১৯০৯ সালে তিনি মাত্র ৫ জন ছাত্রীকে নিয়ে ভাগলপুরে ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে তিনি পুনরায় কলকাতার এক গলিতে মাত্র ৮ জন ছাত্রীকে নিয়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল’ স্থাপন করেন। ১৯২৯ সালে বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টায় ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়।”
৩. সমাজসেবায় বেগম রোকেয়ার অবদান : বেগম রোকেয়া তাঁর কর্মজীবন কেবলমাত্র নারী শিক্ষার প্রসার ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্যয় করেন নি, তিনি নারীসমাজকে রাষ্ট্রে যথাযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম করে গড়ে তোলার লক্ষ্যেও কাজ করেছেন। নারীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটানোর জন্য ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এ সমিতির মূল উদ্দেশ্য হলো মহিলাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। এ সমিতির মাধ্যমে
নিম্নরূপ কাজ করা হতো :
১. বিধবা ও সহায়সম্বলহীন মহিলাদের অর্থ সাহায্য করা হতো।
২. দরিদ্র কুমারীদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হতো।
৩. দরিদ্র বালিকাদের শিক্ষার সুযোগ দেয়া হতো।
৪. অসহায় মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটিরশিল্প স্থাপন করা হতো।
৫. দুস্থ মহিলাদের পুনর্বাসন করা প্রভৃতি।
৪. সাহিত্য চর্চায় অবদান : বেগম রেকেয়ার সাহিত্যকর্মের আলোচনা করতে গিয়ে ড. আনিসুজ্জামান তাঁর ‘মুসলিম মানস’ ও ‘বাংলার সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বেগম রোকেয়া বিদ্রূপের শাণিত কষাঘাত নিয়ে মাঠে নামলেন এবং আক্রমণ করলেন ব্যক্তিকে নয়, সমাজের মনোবৃত্তিকে।” সহিত্যকর্মে বেগম রোকেয়ার ছিল জাগরণের বাণী। বেগম রোকেয়ার লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধে নারীমুক্তি, জাতীয় পুনর্গঠন এবং সমাজসেবার আহ্বান ও নির্দেশনা উচ্চারিত হয়েছে। দরিদ্র চাষিদের অবস্থার উন্নতি, গ্রামীণ কুটিরশিল্পের রক্ষা ও বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম। ‘চাষার চক্ষু’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেছেন, “কেবল কলকাতাটুকু আমাদের গোটা ভারতবর্ষ নহে এবং মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি সমস্ত ভারতের অধিবাসী নহে। অদ্য আমাদের আলোচ্যবিষয় চাষার দারিদ্র্য, চাষাই সমাজের মেরুদণ্ড।” বেগম রোকেয়া সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে নারী জাতির সে সময়ের দুরবস্থা এবং করুণ অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার প্রয়াস চালান। বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্মের মধ্যে সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, মতিচুর, অবরোধবাসিনী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক কূপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়ার অবদান অপরিসীম। বেগম রোকেয়া হলেন মুসলিম নারীজাগরণের অগ্রদূত। জ্ঞান শক্তিকে নারীজাগরণের অস্ত্র বিবেচনা করে তিনি বাঙালি নারী জাতির কল্যাণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। বেগম রোকেয়ার জন্ম না হলে নারীসমাজ আজ নিজের স্বীয় ক্ষমতা বলে নিজেকে পরিচয় দিতে পারতো না। বেগম রোকেয়া সমাজ ইতিহাসে জীবনের অর্থ খুঁজেছেন তাঁর সংগ্রাম ও নিরলস সাধনার মাঝে। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম জাগরণের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার সমতুল্য তিনি নিজেই ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a7%8d/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*